ইন্দির ঠাকরুণ, অসহায়তার মূর্ত প্রতীক

রাস্তাঘাটে বা স্টেশনে যখন কোনো অসহায় বৃদ্ধাকে দেখি, কেন জানি না মনে পড়ে যাই পথের পাঁচালীর সেই ইন্দির ঠাকরুণ এর কথা।সহায়-সম্বলহীন বিধবা ইন্দির ঠাকরুণ, বল্লালী বালাই ইন্দির ঠাকরুণ (কারণ, বল্লাল সেন প্রচলিত কুলীন প্রথার শিকারহেতু সকলের গলগ্রহ)।অতি শৈশবে যার বিবাহ হয়েছিল এক বহুপত্নীবিশিষ্ট নামজাদা কুলীনের সাথে। স্বামীর মুখটা তার পরিষ্কার করে মনেই পড়ে না। সেই যে কবে টাকাকড়ি নিতে এসেছিলেন তল্পীবাহক সমেত, তারপর খেরোর খাতায় দাগনম্বর মিলিয়ে পরবর্তী শ্বশুরবাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা দিয়েছেন।
এমন যে স্বামী, হঠাৎ একদিন পত্র মারফত তার মৃত্যু সংবাদ পেয়ে, মাথার সিঁদুর মুছে, মাথামুড়িয়ে বিধবাবেশ ধারণ করলেন ইন্দির ঠাকরুণ। হয়ে পড়লেন ভাইয়ের সংসারে গলগ্রহ। এ কাহিনী শুধু তার একার নয়। সেইসময়ের বাংলার ঘরে ঘরে হাজার হাজার অসহায় বিধবার কথা।

ইন্দির ঠাকরুণ চরিত্রের সৃষ্টিকর্তা, বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘মেনকা’ নামে এরকম একজন বিধবা পিসি ছিলেন, মহানন্দ ও মৃণালিনী দেবীর সংসারে। যিনি ছিলেন এরকমই গলগ্রহ। যাদের কাছে ‘ লাথি ঝাঁটা পায়ের তল/ভাত কাপড়টা বুকের বল’। এনাকে দেখেই লেখক সৃষ্টি করেছিলেন অসহায়ত্বের মূর্ত প্রতীক ইন্দির ঠাকরুণ কে। সব থেকে কষ্ট লাগে যখন দেখি বেঁচে থাকার জন্য ন্যূনতম প্রয়োজন
খাদ্য-বস্ত্র-বাসস্থানের জন্য এর দরজা থেকে তার দরজায় কুকুর বিড়ালের মত ঘুরে বেড়াচ্ছেন! আর রাস্তার ধারে সেই অসহায়ের মত মৃত্যু চোখে জল এনে দেয়।

এমনকি, এই চরিত্রে অভিনয়কারী চুনীবালা দেবী, তিনিও কম অসহায় ছিলেন না। অসামান্য প্রতিভাশালী অভিনেত্রী হওয়া সত্ত্বেও যিনি সারাজীবন পাননি তাঁর যোগ্য মর্যাদা। যাঁকে আশ্রয় নিতে হয়েছিল পতিতালয়ের অন্ধকারে।
শেষজীবনে এসে এই চরিত্রে অভিনয় করার জন্য যে স্বীকৃতি পেয়েছিলেন তিনি, তাও জীবদ্দশায় দেখে যাওয়ার সৌভাগ্য হয়নি তাঁর।

ইন্দির ঠাকরুণ, মেনকা দেবী, চুনীবালাদেবী বাংলার ঘরে ঘরে আজও বিদ্যমান, ভিন্নরূপে, ভিন্ন পরিস্থিতিতে। তাদের মধ্যে কেউ বৃদ্ধ বয়সে সংসারের গলগ্রহ। তারা অনেকেই হয়তো ইন্দির ঠাকরুণের মত বিধবা বা সন্তানহীন নন।তবুও তাদের অসহায়তাও কিছু কম নয়। ভাগের মা বলে একবার এ সন্তানের সংসারে, একবার ও সন্তানের সংসারে একটু খাবার, একটু আশ্রয়ের প্রত্যাশায় ছুটে বেড়াতে হয়। কেউ হয়তো সেটুকুও পান না।কারো আবার জোটে বৃদ্ধাবাস। কেউ আবার নিজের প্রতিভা বিকাশের সুযোগ পান না। পান না স্বীকৃতিটুকুও।

Facebook Comments Box

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *