চিরসখা

(১)
‘তুমি নির্মল কর মঙ্গল,করে মলিন মর্ম মুছায়ে’
চান্দ্রেয়ী দেবীর গানের সাথেই ‘বেলাশেষে’-র সকলের আরো একটি দিন শুরু হল৷ এ শহরে’বেলাশেষে’ এখন এক বিখ্যাত বৃদ্ধাশ্রম৷ কর্ণধার সুজনবাবু এখানকার বাসিন্দাদের সুখস্বাচ্ছন্দ্যের দিকে বরাবর ই নজর দেন৷ যথাযথ মানের খাওয়া দাওয়া ,সুচিকিত্সা ,মাসে একদিন সিনেমা দেখা,বাত্‌সরিক পিকনিক আরো কত কি..
(২)
‘মা,তোমার চা এনিছি’-বলতে বলতে ঘরে ঢুকলো শ্যামলী,এখানকার সবার নয়নের মণি,সবার দেখাশোনা করে ও৷ চান্দ্রেয়ী দেবী বললেন -হ্যাঁ রে আজকের খবরের কাগজটা কই?
-ও তো ওই নতুন যিনি এয়েচেন তার ঘরে৷
-আচ্ছা তুই আয়৷
পায়ে পায়ে তিনি এগোলেন নির্মলা দির ঘরের দিকে৷ এই মানুষ টাকে বেশ ভালো৷সারাজীবন দাপটে সংসার করেছেন, স্বামী মারা যাওয়ার পর নিজেই এসেছেন এখানে৷ আর চান্দ্রেয়ী দেবীও ছিলেন হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষিকা ,অবসরের পরে এখানে এসেছেন,পেনশনের মোটা অংশ এখনও বাড়িতে পাঠান৷
-ও নির্মলা দি কি করছ? চলো বাগানটা দেখে আসি,গাছগুলোর কতটা কি হলো, বলতে বলতে ঘরে ঢুকে দেখলেন ঘর ফাঁকা৷ চান্দ্রেয়ী দেবী ও ঘর থেকে বেরিয়ে বাগানের দিকে যাচ্ছেন এমনসময় প্রভাত বাবু এসে বললেন-এই চান্দ্রেয়ী,আজ ভোরে যিনি এলেন আমরা সবাই তার ঘরে,তোকে ডাকতে এলাম৷ চল৷
খানিকটা দোনোমনো করেই সেই নতুন ব্যক্তির ঘরের দিকে পা বাড়ালেন চান্দ্রেয়ী দেবী৷ এভাবে যেচে আলাপে তিনি চিরকালই অস্বস্তিতে পড়েন৷
(৩)
-যা বলেছেন মশাই,এই মোহনবাগান-ইস্টবেঙ্গল নিয়ে তর্ক কখনো থামবেনা৷
-তুই আর কথা বলিসনা বিকাশ,শেষ কবে তোরা ‘কলকাতা লীগ’পেয়েছিস বলতো?মনে রাখিস চিংড়ি মেরুদণ্ডহীন৷
-বিকাশদা তুমি কিন্তু.. আচ্ছা আচ্ছা আপনারা তো এলেন আমার সাথে গল্প করতে,আর নিজেরা ঝগড়া করছেন বিকাশবাবু?
-হ! এইডা এক্কেরে হক কথা কইলেন৷বাদ দ্যান অগো কথা৷আমি হইলুম গিয়া ধনঞ্জয় বিশ্বাস ,এহানকার সবথেকে বেশী বুড়া,তবে এহনও দিব্য ফিট,এইডা অবিনাশ,প্রভাত রে তো আগেই দ্যাখলেন,
-আমি মনোজ আর ও জোসেফ, আর ইনি হলেন প্রতিমা দেবী
-নমস্কার
-হ্যাঁ দাদা দেখবেন আপনার খুব ভালো লাগবে এখানে৷এ হলো তপতীদি,মানসী, আর নির্মলা দি৷আর বাকিরা নানা কাজে৷
এই যে আরেকজন এলেন,বলতে বলতে ঘরে ঢুকলেন প্রভাত বাবু৷ তার পিছনে চান্দ্রেয়ী দেবী ঘরের চৌকাঠে সেই ভীষণ চেনা চোখ দুটো দেখে থমকে গেলেন৷
এভাবেও ফিরে আসা যায়?
(৪)
-তোমাকে ছাড়া আমি থাকতে পারবো না,সব কিছু ছাড়তে রাজি আমি ৷ কিন্ত তোমাকে না পেলে সব মিথ্যে ইকবাল ৷
-তোকে ছাড়া আমিই থাকতে পারব?জীবন টাযে তোর নামেই লিখেছি চান্দ্রেয়ী ৷
আরো একবার মিশে গেছিল শরীর দুটো৷ সেদিন বাড়ি ফেরার পরই সব জানাজানি হয়ে গেছিল৷ মারধোর কিছুই বাদ যায়নি৷ ওদিকে ইকবালের বাবাও সেসময়ের গোঁড়া মুসলিম৷ না ওরা কেউ ই সেদিন কিছু করতে পারেনি৷বাবার চাপে ইকবাল বাধ্য হয় বিদেশে পড়তে চলে যেতে,ওখানেই থেমে যায় একটা ১৮ আর ২২ বছরের স্বপ্ন৷সেই দিনের চিহ্ন হিসাবে চান্দ্রেয়ীর গর্ভে সন্তান আসে,না চান্দ্রেয়ী ওকেও রাখতে পারেনি৷ এরপর সে পুরোপুরি গুটিয়ে নেয় নিজেকে ,নিমগ্ন করে পড়াশোনায়,চাকরি পায়,শত অনুরোধেও বিয়েটা করেনি৷ ভাইয়ের সংসারে গলগ্রহ হবে না বলেই এখানে এসেছে..
সেই সময় গুলো তখন থেকে চোখের সামনে ভাসছে,দুপুরবেলা খেতেও যেতে পারেনি৷কিন্তু ইকবাল এখানে কেন? খুব ইচ্ছে করছে ওর সাথে কথা বলতে,কিন্তু এখন এভাবে গেলে সেটা খারাপ দেখায়৷
-কিরে চন্দু,ঘর অন্ধকার কেন?দুপুরে খেতে গেলিনা,কি হয়েছে ?
-কিছুনারে খুব মাথা ধরেছিল৷
-চল সন্ধ্যারতির সময় হলো তো
-হ্যাঁ চল
(৫)
চান্দ্রেয়ীকে এখানে এভাবে দেখবো ভাবিওনি৷ কত বদলে গেছে ও৷ কিন্তু ও স্বামী সন্তান ছেড়ে এখানে কি করছে?সত্যিই জীবন কি আজব রঙ্গমঞ্চ!যেখানে দুজনের সবটুকু ভাগ করে নেয়ার কথা ছিল সেখানে সবই কেমন এলোমেলো হয়ে গেলো৷ আজকালকার প্রজন্ম সত্যিই কত এগিয়ে গেছে, বিদেশে তো বটেই,এমনকী ভারতেও প্রাক বিবাহ যৌনতা কোন ব্যাপার না এখন আর,সমকামীতাও জায়গা করে নিচ্ছে,এই প্রজন্ম কত দক্ষ ভাবে সব সামলায়,অথচ তাদের সময়…
-বলি ও ইকবাল বাবু,আমাদের এখানে সন্ধ্যাবেলা আরতি হয়,তারপর একটু সান্ধ্যভ্রমণে যাই সকলে,চলুন
-বিপিনবাবু,আজ অনেকটা journey করে এসেছি,বড় ক্লান্ত আর তাছাড়া আমি তো..
-আরে ধুর মশাই এখানে ওসব মানা হয়না৷যোসেফ ও সব কাজ করে৷আচ্ছা বিশ্রাম নিন
(৬)
মন্দিরে বারবার চান্দ্রেয়ী দেবীর চোখ খুঁজছিল তাকে৷নির্মলা দেবী ধমক দিলেন,এই চন্দু,কি দেখছিস এদিক সেদিক?
-না ওই নতুন ভদ্রলোক এলেন না?
-ও ইকবাল আজ খুব ক্লান্ত
-উনি কোথা থেকে এসেছেন?
-বলি তোর হলো কি!সম্বন্ধ করবো?
-ধ্যাত তোমরা না…
নাহ!রাতেও ইকবাল আসেনি!আজ আর ‘বেলাশেষে’র দুই বাসিন্দার চোখে হয়তো ঘুম নামবে না৷
(৭)
-কেমন আছো ইকবাল?তুমি এখানে কেন?বিয়ে করোনি?আর এতদিন ছিলেই বা কোথায় ?
-ওরে বাবা! এতগুলো প্রশ্ন !একটা একটা করে বলছি৷
যেভাবে জীবন রেখেছে সেভাবেই আছি৷বিদেশেই ছিলাম৷২ মাস আগে এলাম৷আব্বা আম্মু তো কবেই….পিছুটান ছিলোনা৷
-মানে তুমি !!
-নারে,বিয়েটা অনেকদিন আগে ছাতিমপুরের এক সন্ধ্যাবেলা বটতলায় হয়েছিল৷
-ইকবাল…
-হ্যাঁ ,আব্বা তখন জোর করে বাইরে পাঠিয়ে দিল,তোর সাথে যোগাযোগ ছিল অসম্ভব৷এতগুলো বছরে কত মেয়েকে দেখলাম ,কিন্তু ‘তুই’টার অভাব ছিল
-জীবন খুব কঠিন ইকবাল৷বাবা মা খুব জোর করত বিয়ের জন্য ৷পাত্রপক্ষের সম্মুখীনও হয়েছি,কিন্তু আমার সেই ‘দুরন্ত পুরুষ’ কে পাইনি৷
-কাল সারারাত এসবই ভেবেছি জানিস
-হয়তো এটাই ভবিতব্য ছিল আমাদের
-হয়তো…
-চলো এবার ,হাঁটতে হাটতে অনেকদূর এসে গেছি৷আজকাল সন্ধ্যাবেলা বেশ ভালোই ঠান্ডা পড়ে

(৮)
একমাস পর….

এখন সকালের প্রাতঃভ্রমণ থেকে সন্ধ্যার পায়চারি সবেতেই চান্দ্রেয়ী দেবীর সঙ্গী এখন ইকবাল বাবু৷ ওরা দুজনে জীবনের বেলাশেষে আরো একবার খুঁজে পেয়েছে নিজেদের৷সবাই বলেছিল আইনি স্বীকৃতির কথা,ওরাই রাজি হয়নি৷এই বয়সের নির্ভরতা তো আর শুধু ২টো সইয়ের উপর নির্ভর করেনা৷ আবার যে কখনও দেখা হবে সেটাই তো ভাবেননি ৷তাই তারা এভাবেই বাকিটা জীবন কাটিয়ে দিতে চান৷ প্রেম শুধু শরীর ছুঁয়ে হয়না,মনের প্রেম অনেক বেশী শান্তি দেয়৷৪৪বছর আগের ধর্মীয় গোঁড়ামিতে আটকে যাওয়া প্রেম টা আজ এক নতুন পূর্ণতা পেল৷’বেলাশেষে’ও সূর্যের স্নিগ্ধকিরণ ছুঁয়ে গেছে ওদের৷

Facebook Comments Box

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *