চোখের আলোয় দেখেছিলেম…
“এই দাদা, ওই দ্যাখ, এখান থেকেই সমুদ্রটা দেখা যাচ্ছে রে। কি সুন্দর! নীল নীল জলের মধ্যে কেমন ভেসে বেড়াচ্ছে সাদা ফেনাগুলো। কত্ত লোক দেখ সমুদ্রের ধারে। আচ্ছা, ওরা সবাই কি স্নান করছে? দেখ, এখান থেকে সবাইকে কেমন যেন ছোট্ট ছোট্ট পুতুলের মতন দেখাচ্ছে। আচ্ছা দাদা এখানে এত বালি কোথা থেকে এল বলতো? ও বাবা! ওই দ্যাখ দ্যাখ, জলের ওপর সূর্যের আলোটা পড়ে কেমন সুন্দর চকচক করছে!”— কথাগুলো প্রায় এক নিশ্বাসে সৌমেনের উদ্দেশ্যে বলে তারপর থামল দীনেন। ওর কথায় স্পষ্ট প্রকাশ পাচ্ছিল ওর ভিতরের উত্তেজনা। আর তা হবে নাই বা কেন? গত ১০ বছরে যে এই প্রথম ওদের পা পড়লো আশ্রমের বাইরে, তাও আবার প্রথমবারেই সমুদ্র দর্শন…
ওরা দুই ভাই, সৌমেন আর দীনেন। সৌমেন ১৫ আর দীনেন ১০। ওদের নিবাস পুরুলিয়ার আনন্দপুরী অনাথ আশ্রমে ওদেরই মতো আরও গোটা ২০ বাচ্চার সাথে। ওরা জানেনা ওদের বাবা-মায়ের পরিচয়, জন্মে থেকে দেখেওনি বোধহয় তাদের। সেই কোন ছোট্টবেলায় কেউ হয়তো ওদের রেখে গেছিল এই আনন্দপুরী অনাথ আশ্রমে, তা ওদের মনেও পড়েনা। তারপর থেকে এটাই ওদের বাড়ি। এখানেই ওদের পরিবার, ওদের সব কিছু।
পূজোর ছুটিতে এই আশ্রমেরই ২০-টা বাচ্চাকে সাথে নিয়ে আশ্রমের বড়োরা বেড়াতে এসেছে শ্রীক্ষেত্র পুরী-তে, ওদের সমুদ্র দেখাবে বলে। ছোটো ছোটো শিশুগুলোকে দেখে মনে হচ্ছিল যেন ওদের মনের দক্ষিণের জানালা কেউ খুলে দিয়েছে আর সেখান থেকে ধেয়ে আসছে দমকা দখিণা বাতাস। ওদের বাঁধ ভাঙা আনন্দ ছিল দেখার মতো।
সারাদিনের যাতায়াতের ধকলের পর বাচ্চারা সবাই ক্লান্ত, লজে এসে সবাইকে খাইয়ে ঘুম পাড়িয়ে দেওয়া হল রাত ১০টার মধ্যে, কিন্তু ঘুম নেই দীনেনের চোখে। সে অপেক্ষা করছে ভোরের উদীয়মান সূর্যের, শ্রীক্ষেত্রের এক নতুন সকালের।
“এই দাদা সমুদ্রের ধারে ভোরের সূর্য দেখতে কেমন লাগে রে? অনেক বড়ো দেখায়? থালার মতো বড়ো? ডিমের কুসুমের মতন দেখতে লাগে, তাই না?”— মাঝরাতে ঘুমের ঘোরে দাদাকে একের পর এক প্রশ্ন করে গেল দীনেন, কিন্তু দাদাও যে তখন ঘুম পরীর জগতে রঙিন স্বপ্ন দেখতে ব্যস্ত।
পরদিন সকাল সকাল আশ্রম কর্তৃপক্ষ বাচ্চাদের নিয়ে বেড়িয়ে পড়ল শ্রীক্ষেত্রে সমুদ্র দর্শনে। বালুকাবেলায় ভোরের স্নিগ্ধ সূর্যালোকে ছুটে বেড়াচ্ছিল আশ্রমের ছোট ছোট শিশুরা, দেখে মনে হচ্ছিল যেন নতুন সকালে একদল প্রাণোচ্ছল বালিহাঁস জলকেলি করছে।
দীনেন: দাদা, সূর্যটা দেখলি? ওটা দেখতে তো আরও অনেক বেশী সুন্দর হয়ে গেছে রে। আচ্ছা, এই একই সূর্য কি পুরুলিয়াতেও ওঠে? কই তখন পাহাড়ের মাঝে তো এমন দেখায় না!
সৌমেন: ধুর বোকা! সূর্য একটা নয় তো আবার ক’টা হবে? যে সূর্য পাহাড়ে দেখিস, আজ তাকেই এখানে দেখলি। আসলে সবটাই প্রকৃতির খেলা রে ভাই। পাহাড়ের মাঝে এতদিন এই একই সূর্যের এক অন্য রূপ দেখে এসেছিস, আর আজ সমুদ্রে নেয়ে সমুদ্রের বুক থেকে ওঠা সেই একই সূর্যের আরেক রূপ দেখলি। বুঝলি?
দীনেন: সত্যি! সমুদ্রটা কি বড় তাই না রে? এটার তো শুরু শেষ কিছুই দেখতে পাচ্ছিনা।
সৌমেন: আরে সমুদ্র তো বিশাল হয়। এর শুরু শেষ কিচ্ছু দেখা যায়না। এ এক গভীর দিগন্তবিস্তৃত জলরাশি।
দীনেন: আমাদের আশ্রমের পুকুরের থেকেও গভীর?
সৌমেন: কি যে বলিস বোকার মতো!
আশ্রম সুপার: দেখিস দীনেন, দাদাকে সাবধানে ধরে ধরে নিয়ে আসিস। বালির তলায় কোথায় কী আছে কে জানে? হোঁচট খেয়ে পড়ে না যায়। আমি এগোলাম। তোরা আয় তাড়াতাড়ি। তোদের সমুদ্র দেখা হলে তোদেরকে লজে বাসুর কাছে রেখে বাজারে যেতে হবে।
দীনেন: হ্যাঁ স্যার, আসছি।
দাদা তুই আমার হাতটা শক্ত করে ধর, আমি তোকে সমুদ্রের কাছে নিয়ে যাচ্ছি। তারপর আমরা দুজন মিলে সমুদ্রের জলে পা ভেজাবো, তারপর মন্দিরে যাব। স্যার যেন আরও কোথায় কোথায় যাওয়ার কথা বলছিল জানিস দাদা…
দাদার হাতটা শক্ত করে ধরে সোনালি বালির ওপর দিয়ে হেঁটে চলল দীনেন। সারল্য মাখা তাদের সম্পর্কে কত দায়িত্ব ছোট ভাইটার…
সৃষ্টিকর্তা সৌমেনের চোখের আলো কেড়ে নিয়েছে তাকে সৃষ্টি করার সময়ই। তার পৃথিবীটাই অন্ধকারাচ্ছন্ন। কিন্তু তাকে নতুন করে আলো দেখতে শিখিয়েছে তার বছর দশেকের ছোট্ট ভাইটা। সে এই পৃথিবী দেখে তার ভাইয়ের চোখে, অন্যরকম ভাবে…
দীনেনের হাতটা শক্ত করে ধরে সমুদ্রের দিকে যেতে যেতে সৌমেন গুনগুন করে উঠল—
“চোখের আলোয় দেখেছিলেম চোখের বাহিরে।
অন্তরে আজ দেখব, যখন আলোক নাহিরে।।…”