।। জীবনের লংড্রাইভ ।।
“— বরমশাই, আজ একটা ইভেন্ট অ্যাটেন্ড করতে হবে, তাই লং ড্রাইভ ক্যানসেল। বর বুঝবে তো বউয়ের অসুবিধাটা?
— আবার ক্যানসেল? বর আর কিচ্ছু বুঝবেনা।
— এমন পেশার বউকে ভালোবাসলে বুঝতে তো হবেই…
— বউ তো সবসময়ই ব্যস্ত, বরের দিকে তাকানোর সময়ও নেই।
— কী আর করবে সে? ঘরে বাইরে সামলে তাকানোর সময় কই?
— বর তো ঘরের কাজে সাহায্য করে…
— সেই… সাহায্যের বদলে কাজ আরও বাড়িয়ে দেয়।
— আচ্ছা বাবা! আমি নাহয় আর একজন কাজের লোক রেখে দেবো… এবার যাবে তো লংড্রাইভ?…”
আবির— কলি, এটা ঠিক হচ্ছেনা কিন্তু। এ তো আমাদের বিয়ের শুরুর দিকের প্রেম। আর এটা নিয়ে স্পেশাল স্টোরি? বরের কথার ক্রেডিট আমার চাই…
কলি— ব্যাস! আবার শুরু? সুযোগ পেলেই হল, সবেতেই নিজের ক্রেডিট চাই। এখন যাও তো বিরক্ত কোরোনা। কাল সকালের মধ্যে বাঙালির ভ্যালেন্টাইনস্ ডে’ র স্পেশাল এডিশনের লেখাটা জমা না দিলে এডিটর হাতে শিলিগুড়ির ট্রান্সফার লেটারটা হাতে ধরিয়ে দেবে।
আবির— ভালোই তো। তুমি আর আমি রোজ পাহাড়ের কোলে ঘুরে বেড়াব। সকালে তোমার হাতের দার্জিলিং চা আর পাহাড়ি হাওয়ায় ঘুম ভাঙ্গবে আমার।
কলি— সেই… আর নির্লজ্জের মতো বউয়ের পয়সায় বসে বসে বসে খাবে, কারণ নিজের চাকরিটাও তো জলাঞ্জলি দেবে।
আবির— হ্যাঁ, বেশ হবে কিন্তু।
তুমি করবে রোজগার, আর আমি করব রান্না…
কলি—তোমার হাতে সংসার দিয়ে চুলোয় যাক্ ঘরকন্যা। এবার কি তুমি যাবে?
আমি কথাকলি, পেশায় সাংবাদিক আর নেশায় গৃহিণী। সমাজের বাঁধাধরা নিয়মের বাইরে কিছু করতে চাওয়ার আগ্রহ আমার চিরকালের। সবাই বলে, “নেশা আর পেশা এক হলে নাকি জীবনের স্বাদ বদলে যায়।” তাই অ্যাডভেঞ্চারের নেশার পিঠে চড়ে সাংবাদিকতায় প্রবেশ।
আমার বর শ্রীমান আবির চ্যাটার্জী। পেশায় আইটি কর্মচারী। আর নেশা? নিজের পাগলামি দিয়ে আমার কাজের ব্যাঘাত ঘটানো। তার নমুনা তো দেখতেই পেলে…
সবার কাছে সাংবাদিকেরা যেন পৃথিবীর বাইরের এক অন্য জগতের বাসিন্দা, যেখানে তাদের সঙ্গী শুধুই কাজ। কেউ যেন মানতেই চায়না সাংবাদিকদেরও এক নিজস্ব জগত আছে। জীবনসঙ্গী… মা-বাবা… ছেলে-মেয়ে আছে, এদের নিয়ে থাকা সেই ব্যক্তিগত জীবনে তারাও চূড়ান্ত গৃহী।
অদ্ভুত এ সংসার!
এই লোকজনই আবার ভাবে আমরা চরম গ্ল্যামারাস জীবন কাটাই। আর সাংবাদিক যদি মেয়ে হয় তাহলে তো তার গায়ে বিশেষ বৈশিষ্ট্যের তকমা পড়েই যায়; ছোট চুল আর হাতে সিগারেট। না! আমার কোনোটাই নেই… চুল ও মাঝারি আর সিগারেটও ঠিক পোষায় না। তবুও আমি সাংবাদিক! ওই লিখতে একটু আধটু পারি আর লেখালেখি ভালবাসি অনেকটা।
পেশাটা বেশ নায়কোচিত মনে হলেও কদিন পরেই শুরুর সমস্ত উৎসাহ পরিণত হয় “যাই! যাই!”-তে। কোনো স্টোরি বাতিল হলে খারাপ লাগার থেকেও পরের স্টোরিটা সফল হলে বরকে দেখিয়ে ‘Show-off’ করতে আনন্দ হয় বেশি। কিন্তু সে আনন্দই বা কতক্ষণের… হয় উনি নয়তো ওনার মেয়ে কোনো না কোনো কাজ বাঁধিয়ে বসবেন।
ও! বলতে ভুলে গিয়েছিলাম আমাদের মেয়ে আসেই চ্যাটার্জী, বাবার আদরের দুলালী আশা। অনেক ভেবে উনি ওনার মেয়ের নাম দিয়েছেন নিজের প্রথম প্রেমিকার মাতৃভাষা তামিলে। বাবা মেয়ের দৌরাত্ম্যতেই কাটে আমার সমস্ত ছুটির দিন।
আমার একটা লেখা ছাপা হতে দেরি হচ্ছিল বলে, ওনার প্রজেক্টের সফলতার জন্য বাপ-মেয়ে মিলে খুব ‘Show-off’ করছিল। লেখাটা যেদিন প্রকাশ পেলো ভাবলাম খুব কথা শোনাবো দু’জনকে… বাড়ি ফিরতেই দেখলাম লেখার টেবিলে আমার প্রিয় ফুলদানিতে একগোছা সাদা আর গোলাপী গোলাপ পাশে একটা চকোলেট আর চিঠি,
“বেস্ট মা,
কদিন রোজ নিজের হোমওয়ার্ক করে নেবো, একদম জ্বালাতন করবো না তোমাকে। Love you মা!
—তোমার আশা
সাংবাদিক বউ,
আগামী দু’মাস কাজের সময় নো লংড্রাইভ, আর নো বোকা বোকা কবিতা। promise…
—অতি সাধারণ বর”
আমাদের সাংবাদিকের জীবনেও সব কাজের ভিড়েও থাকে কিছু স্পেশাল দিন, স্পেশাল মুহূর্ত, একরাশ অভিমান, এক ফালি সুখ…
কখনও ইভেন্ট অ্যাটেন্ড করতে গিয়ে মনে পড়ে আশার হোমওয়ার্কের কথা কিংবা সমাজের কোনো বিশেষ মানুষের ইন্টারভিউ নিতে অপেক্ষা করাতে হয় আমার জীবনের ‘বিশেষ মানুষ’টাকে। এই দ্বন্দ্ব, বাধা, ভালোবাসা আর বোঝাপড়াতেই কেটে যায় প্রতিদিন।
হ্যাঁ, আমি সাংবাদিক হিসেবে হয়তো আকাশছোঁয়া সফলতা পাইনি। কিন্তু আমি যা পেয়েছি তা কতজন পায়? কাজের জগতের সফলতার পাশাপাশি আমি এক সফল পরিবারের অধিকারী। এক আদুরে মা আর আর এক ঝগড়ুটে স্ত্রী আমি। আর এই সকল পরিচয় পরিপূর্ণ করেছে ‘আমি’কে।