ঠাণ্ডা মাথার খুনি
মনুষ্যজাতির প্রত্যেকের মধ্যে একাধিক সত্ত্বা থাকে। কিছু সত্ত্বা ভালো দিকে ও অন্যটা খারাপ দিকে চালিত করে, সবাইকে।
‘সিরিয়াল কিলার’, এক পরিচিত ও ভয়ংকর অনুভূতি সমাজের জন্য!
মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা FBI-এর মতে, “যখন কোনো মানুষের ক্ষোভ-লোভ-হিংসা এতটাই বেড়ে যায় বা নিজের শারীরিক ও মানসিকভাবে নোংরা ইচ্ছেগুলো বেশি প্রাধান্য পায়, তখন মানুষ নিজের মধ্যে থেকে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলে। এক মানসিক রোগগ্ৰস্ত জীবে পরিণত হয় এবং কোনো উদ্দেশ্য ছাড়াই ক্রমাগত ঠাণ্ডা মাথায় খুন করে যায়।”
এরা এক বিশেষ ধরণের খুনি যারা একাধিক বা সিরিয়ালি তিন-চারটের বেশি খুন করে থাকে। এদের সাথে ভিক্টিমের কোনো সরাসরি সম্পর্ক থাকেনা, মূলত দৈহিক ও মানসিক লোভ বা হিংস্রতা মেটাতে ঠাণ্ডা মাথায় খুনগুলো করে। সিরিয়াল কিলাররা বেশিরভাগ মানসিক রুগী হয় বা অনেকে অনুপ্রাণিত হয়েও এই কাজে নেমে পড়ে বা এদের খুনের ধরনই হল একে অপরের সাথে মিল খুঁজে খুন করা।
পৃথিবীর ইতিহাসে ভয়ঙ্কর কিছু সিরিয়াল কিলার সম্বন্ধে জেনে নেওয়া যাকঃ
১. জিল দ্য রাইঃ
১৪০৪ সালে ফ্রান্সে এই কুখ্যাত সিরিয়াল কিলারের জন্ম হয়। তার পুরো নাম জিল দ্য রাই। এই খুনি নিজ হাতে প্রায় শতাধিক ব্যক্তিকে হত্যা করেছিল যাদের বেশিরভাগই ছিল বালক শিশু এবং এরা সবাই ছিল ব্লন্ড চুল ও নীলচোখের অধিকারী।
সবচেয়ে আশ্চর্যের ব্যাপার হচ্ছে জিল নিজেও ছেলেবেলায় এদের মতোই ব্লন্ড চুল ও নীল চোখের অধিকারী ছিলেন।
তার খুনের সংখ্যা নিয়ে ধন্ধে থাকে বিশ্বের গোয়েন্দা সংস্থাগুলো। প্রায় ৮০-২০০ জনকে খুন করেছেন আবার অনেকে মনে করেন খুনের সংখ্যা ৬০০-এর বেশি।
২. টেড বান্ডিঃ
তাকে বলা হয় আমেরিকার সবচেয়ে কুখ্যাত সিরিয়াল কিলার। ইতিহাসে স্মরণীয় এই সিরিয়াল কিলারের জন্ম ১৯৪৬ সালে। ১৯৭৪ থেকে ১৯৭৮ সাল পর্যন্ত অসংখ্য নিরপরাধ তরুণীকে খুন করে সে। টেড দেখতে অত্যন্ত সুদর্শন ছিল। সে খুনের জন্য বিভিন্ন ছদ্মবেশ ধারণ করতো।
মূলত, তরুণীরা বেশি শিকার হতো, খুন করার আগে ও পরে ধর্ষণ করতো সে।
এরপর জানা যাক কিছু ভারতীয় সিরিয়াল কিলারের কথাঃ
৩. সায়নাইড মোহনঃ
আসল নাম মোহন কুমার। লোভ দেখিয়ে অবিবাহিত তরুণীদের ডেকে তাঁদের সঙ্গে যৌন সঙ্গম করত মোহন। এরপর, কৌশলে ওই মেয়েদের গর্ভনিরোধক পিল খাওয়াতো সে। কিন্তু মহিলারা জানতেন না ওই গর্ভনিরোধক পিল আসলে সায়নাইডের বিষ। ২০০৫ থেকে ২০০৯ সাল পর্যন্ত ২০ জন মেয়েকে এভাবে খুন করে সে। প্রাইমারি স্কুলের ‘ফিজিক্যাল এডুকেশন’-এর শিক্ষক ছিল মোহন। ২০১৩ সালে তার মৃত্যুদণ্ডের সাজা হয়।
৪. চার্লস শোভরাজঃ
ভারতে এখনো পর্যন্ত যত খুনি এবং অপরাধমনস্ক লোকের কথা জানা যায় সেই তালিকার সর্বোচ্চ স্থানে চার্লস শোভরাজ। একটা সময় শুধু ভারত নয়, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বহু দেশের পুলিশের রাতের ঘুম কেড়ে নিয়েছিল সে। মাদক চোরাচালান থেকে সুন্দরী মহিলাদের খুন। ১৯৭৫ থেকে ১৯৭৬-এর মধ্যে মোট ১২ জনকে খুন করে শোভরাজ। তার শিকারদের খুন করে, অর্থ এবং দামি জিনিস লুঠ করত সে। বিকিনি পরিহিত দুই মহিলাকে খুন করেছিল সে। তখন থেকে তার নাম হয় ‘বিকিনি কিলার’। ১৯৭৬ থেকে ১৯৯৭ পর্যন্ত ভারতে কারাগারে কাটানোর পর ছাড়া পেয়ে প্যারিস চলে যায় সে। ২০০৪ সালে নেপালে গিয়ে সেখানেও গ্রেফতার হয়। আপাতত সেখানে কারাগারে বন্দি শোভরাজ। সম্প্রতি তাকে নিয়ে বলিউডে সিনেমা হবার কথা শোনা গেছে।
এইরকম ‘সিরিয়াল কিলিং’-এর মনোভাবকে কাজে লাগিয়ে বেশ কয়েকটি হলিউডের ছবি তৈরী করা হয়েছে।
তাদের মধ্যে কিছু ছবির সম্পর্কে জেনে নেওয়া যাক—
১. ম্যানহান্টার (১৯৮৬):
এই ছবিটিই সর্বপ্রথম হ্যানিবাল লেকটার চরিত্রটিকে পর্দায় নিয়ে আসে। থমাস হ্যারিসের ‘রেড ড্রাগন’ উপন্যাস অবলম্বনে ছবিটি বানিয়েছেন মাইকেল ম্যান। ক্রিমিনাল ইনভেস্টিগেশনে ফরেনসিক সায়েন্সের ব্যবহারের ওপর নির্মিত চলচ্চিত্রটি আরো অনেক ছবির অনুপ্রেরণা হয়ে থেকেছে পরবর্তী সময়ে।
মূলত, এই ছবিটিই খুব পরিষ্কার ও স্বাচ্ছন্দ্যে বর্ণনা করেছে ‘সিরিয়ার কিলিং’-এর বিষয়বস্তু।
২. হেনরি—পোর্ট্রেইট অব এ সিরিয়াল কিলার (১৯৮৬):
এই লিস্টে জায়গা করে নেওয়া একমাত্র চলচ্চিত্র, যেটি নিষিদ্ধ হয়েছিল। ছবিটি ১৯৮৬ সালে কাজ শেষ করলেও সেন্সরবোর্ড থেকে ছাড়া পেতে অপেক্ষা করতে হয় আরো চার বছর।
৩. দ্য সাইলেন্স অব দ্য ল্যাম্বস (১৯৯১):
চলচ্চিত্র ইতিহাসের শ্রেষ্ঠতম সাইকোলজিক্যাল থ্রিলারও বলা হয় এটিকে। অস্কার জয় করেছিল প্রধান পাঁচটি ক্যাটেগোরিতে (সেরা ছবি, সেরা পরিচালক, সেরা অভিনেতা, সেরা অভিনেত্রী ও সেরা চিত্রনাট্য)। এছাড়া বাফটা আর গোল্ডেন গ্লোব অ্যাওয়ার্ড— কী নেই এই ছবির সাফল্যের ঝুড়িতে! বিখ্যাত চরিত্র ড. হ্যানিবাল লেকটারকে নিয়ে তৈরি সবচেয়ে জনপ্রিয় চলচ্চিত্র এটি।
৪. আমেরিকান সাইকো (২০০০):
সিরিয়াল কিলারের ওপর নির্মিত আরেকটি অসাধারণ ছবি, জিতেছিল ‘ইন্টারন্যাশনাল হরর গিল্ড’ অ্যাওয়ার্ড। ম্যানহাটনের একজন সফল ব্যাংক বিনিয়োগকারীর ভয়ংকর এক দ্বৈত জীবনের কাহিনী নিয়ে চলচ্চিত্রটি নির্মিত।
এক অনবদ্য জিনিস যা মানবজীবনে রোমহর্ষক ঘটনার মতো অনুভূতি জাগায়।
অবশেষে এটাই বলার যে এই ঠাণ্ডা মাথার খুনিরা হল সেই প্রজাতির জীব যারা সবকিছু করতে পারে এবং নিজেদের আকষর্ণীয় দেখানোর জন্য একধরনের ছাপ ছেড়ে যায় সমাজে।
তাই ভালো থাকুন ও সুস্থ থাকুন। সচেতনতার জালে নিজেদের এবং পরিবারকে আঁকড়ে রাখুন।