সমুদ্রতটে পদচিহ্নের মতো ট্রামের ছাপ তিলোত্তমার বুকে আজও বিরাজমান। রাজার মুকুটের মতো কলকাতার সৌন্দর্যের প্রধান দ্যুতি একে ঘিরেই।
সালটা তখন 1873। পাথরের পর পাথর পেরিয়ে খরোস্রোতা নদীর মতো, শহরের বুক চিরে উদ্দাম গতিতে বয়ে চলেছে সে। নুুুুপুর এর মতো টুঙ টুঙ শব্দে, ট্রাম তখন যেন যুবতী নারী।
“জয়ের ধ্বজা উড়িয়ে ট্রাম এপার হতে ওপারেতে।
রাজপথে বুকে নাম খচিত, আজও সে শিরোমণিতে।।”
সেই সময়কার ভাইসরয় লর্ড কার্জন এর মস্তিষ্কপ্রসূত ট্রামের ব্যবস্থা। এই লর্ড কার্জনকে বঙ্গভঙ্গের মূল কারিগর হিসেবে জানে সবাই। তিনি অবশ্যই সাধারণ মানুষের সুবিধার্থেই এই ব্যবস্থা শুরু করেননি। এরমধ্যেও ছিল অন্য কারন। কলকাতা তখন বন্দর, শহর নিত্যনতুন মালবাহী জাহাজ গঙ্গা এসেই ভীড়ত। সেই মালপত্র কম্পানি বাহাদুরের গুদামে পৌঁছানোর জন্য একটি যানের প্রয়োজন ছিল। সেই কারণেই ট্রাম ব্যবস্থার কথা ভেবেছিলেন কার্জন।
স্মৃতির সরণি লেন ধরে আজ যাওয়া যাক 1873 সালের সেই 24 এ ফেব্রুয়ারিতে। কলকাতার রাজপথে টগবগিয়ে শুরু হল ট্রাম চলা। ঘোড়ার খুরে শিয়ালদা থেকে আর্মেনিয়ার ঘাটে প্রথম পদচারনা। এরপরের সাতবছর হঠাৎ চুপ। কিন্তু 1880 সাল, শহরের বুকে রচিত হল এক বিপ্লব। 1880 সালে 22শে ডিসেম্বর তৈরী হল কলকাতা ট্রামওয়ে কোম্পানি লিমিটেড।
1882 সালে 1লা নভেম্বর চালু হল ঘোড়ায় টানা ট্রাম। কলকাতা ট্রামের এই যাত্রাপথ উদ্বোধন করলেন লর্ড রিপন। 166 খানা ঘোড়া আর 1000 ট্রামের সমন্বয়ে তখন মাথা উঁচু করে এগোচ্ছে। রাজার মতো একের পর এক জয়ের শিরোপা লাভ করছে সে।
পরবর্তী পর্ব শুরু হল 7 টি বাষ্পচালিত ট্রাম নিয়ে। একের পর এক মাইলস্টোন পেরিয়ে 1902 সালে, নিজেকে আরো একধাপ উন্নত করলো। বৈদ্যুতিক ট্রামে রূপান্তরিত হলো। 27 জুন এসপ্ল্যানেড থেকে খিদিরপুর, 14 জুন এসপ্ল্যানেড থেকে কালীঘাটে, শোনা গেল অন্তর্ধনি।
1905 সালে হাওড়া থেকে সালকিয়া, 1908 এ হাওড়া থেকে শিবপুরেও চললো ট্রাম। 1943 সালে জুড়ে দেওয়া হলো হাওড়া কলকাতার ট্রাম লাইন। তারসাথে ওইবছর গঙ্গাবক্ষ পাড় করলো ট্রাম। যত সময় বয়ে চলেছে ট্রামের ছন্দে মুখরিত হয়েছে কলকাতা ও পাশের শহর।
ট্রাম তখন কলকাতা ঘিরে স্বপ্ন সাজছে, ঝলমলে রোদ যেন শহর জুড়ে, আকাশ ছুঁতে চাওয়ার অভিপ্রায়। দুরন্ত গতিতে উদ্দাম যৌবনে ট্রাম ছড়িয়ে দিচ্ছে ভালোবাসার সুবাস। ঢং ঢং আওয়াজে আহ্বান জানাচ্ছে শহরবাসীকে।
“হনহনিয়ে ছুটে যাওয়া ট্রামের মনে সন্ধ্যা নামে।
গল্পগুলো হঠাৎ নিস্তব্ধতায় ঢাকে লাইনগুলো বুকে।।”
কিন্তু হঠাৎ ছন্দপতন, নেমে এলো ঘোর অন্ধকার। ট্রামের অন্ত্যমিল কেটে গেল শহরের শরীর থেকে। একের পর এক বন্ধ হতে লাগল ট্রামের লাইন। 1992 সালে নামলো বাস। মহানগরীর বহু জায়গায় বন্ধ হলো ট্রাম চলাচল।
‘ লাইনগুলো তখন ধুলোর আচড়ে, ট্রাম ভুগছে অস্তিত্ব সংকটে।’
এই ট্রাম দিয়ে শুরু হয়েছিল পথ চলা। এশিয়ার মধ্যে কলকাতাতে প্রথম আধুনিকতার ছোঁয়া এনে দিয়েছিল। একপা দুপা করে উন্নত করে দিয়েছিল শহরকে। অথচ আজ তাকেই জীর্ণ অবস্থায় দেখা যায়। ওই ট্রামে আর প্রেমের গল্প পাতা হয় না, ছুটে চলা শব্দ মনের ভেতর ভালোবাসা জাগায় না। তপ্ত দুপুরে ফেরি করার মত নির্জনতায় ভরা ট্রাম ডাক দিয়ে যায়।
এটাও পড়ুন- অস্তিত্ব দোসরের সহজপাঠ
শহরে আজ প্রয়োজনের সঙ্গে তাল মিলিয়ে যানবাহনের পরিবর্তন হয়েছে। অপরদিকে ট্রাম তখন পথে-প্রান্তরে জরাগ্রস্ত অবস্থায় পড়ে রয়েছে। অথচ এই ট্রাম আসার আগে ভারতের গণপরিবহনের কোন ধারনাই ছিল না। এই ট্রামের ঐতিহ্যগত মূল্য অপরিসীম। অথচ বিশাল জনপ্রিয়, সমাদ্রিত এমন এক জীবন্ত গণপরিবহন ব্যবস্থা যতোনা পরিবতর্নের চাপে অন্তরালে চলে গিয়েছে, তার চেয়ে অনেক বেশি কন্ঠরোধ করে হত্যার চেষ্টা করা হয়েছে। ট্রামের প্রতি বর্তমানে অনেকেই রব তুলেছেন উঠিয়ে দেওয়ার জন্য। কিন্তু তা উঠে গেলে কলকাতার কৌলিন্য হারিয়ে যাবে, হারিয়ে যাবে ঐতিহ্য।
শতাব্দী পেরিয়ে বার্ধক্য ঘিরেছে ট্রামকে। টিকে থাকার সেই দাপট নেই, তবে মনকোণে জমেছে শতাব্দীর অভিমানের মেঘ। কলকাতার সঙ্গে ট্রামের আত্মিক যোগ, সেই যোগ সেই ঐতিহ্য মুছে ফেলা সম্ভব নয়।
তাই নানা টানাপোড়েনের মধ্যেও রয়ে গেছে গুটিকয়েক ট্রাম। আজও মৃদু ধ্বনি বাজিয়ে শহরের বুকে বয়ে চলে সে, তবে ট্রামের মনে এখন একাকীত্ব।