রিক্সা থেকে নেমে গেট দিয়ে ভেতরে ঢুকতেই অবাক হয়ে গেল সন্দীপ। বাড়িটা যে এত বড় হতে পারে তা ওর ধারণাই ছিল না। যতই ভেতরে ঢুকছিল ততই অবাক হয়ে দেখছিল সব। কলেজ ক্যান্টিনে আড্ডার সময় প্রকাশ এই বাড়ির ব্যাপারে বলতো ঠিকই, কিন্তু সন্দীপও আর সব বন্ধুর মতই গুল ভেবে উড়িয়ে দিত সেসব।
মেন গেটটা দিয়ে ভেতরে ঢুকে একটুখানি মাঠের মতো জায়গা। চারিদিকে বিভিন্নরকম ফুলের গাছ। বাড়িটা দোতলাই, কিন্তু বেশ চওড়া। এবারের পুজোটা এরকম একটা বনেদি বাড়িতে কাটাবে ভাবতে পারেনি সে।
দুর্গাপুজো বলতে ছোটবেলায় সন্দীপ বুঝতো নতুন জামা গায়ে জড়িয়ে ক্যাপ-বন্দুক নিয়ে টই টই করে সারা পাড়া ঘুরে বেড়ানো, কোন্ বন্ধুর কত সেট জামা হল, তার লিস্টটা মনে গেঁথে রাখা। সেইদিনগুলো তো কবেই হারিয়ে গেছে…
বড় হওয়ার পর যদিও পুজোর দিনগুলোতে ক্রাশকে আড়চোখে দেখা, বিশেষ মানুষটির সাথে ঘোরারও একটা আলাদা আনন্দ আছে, কিন্তু এবার যেন সন্দীপের সে ভাগ্যও নেই, আগস্টের শুরুতেই ব্রেক আপ হয়ে গেল অপর্ণার সাথে। অগত্যা পুজো পরিক্রমা দেখতে দেখতে বিরিয়ানি-চাপ খেয়ে এবারের পুজোটা কাটাতে হবে ধরেই নিয়েছিল সে। শেষে প্রকাশের জোরাজুরিতে রাজি হল এখানে আসতে। এতদিন সিনেমা কিংবা সিরিয়ালেই
দেখে এসেছে এরকম বাড়ি। আজ স্বচক্ষে দেখে নিজেকে চিমটি কাটতে ইচ্ছে করছে… এতক্ষণে যেন মনে হচ্ছে তার এখানে আসাটা মাটি হয়নি।
কলিংবেল টিপতেই দরজাটা খুলে দিল কেউ। ভেতরটা আরও অবাক হয়ে যাওয়ার মতো। ভেতরে ঢুকতেই একটা ফাঁকা জায়গা, উঠোন টাইপের। মেঝেটা দাবার বোর্ডের আদলে করা। ভেতরে এসে সন্দীপ বুঝলো ও বাইরে থেকে শুধু একপাশটা দেখেছে। উঠোনটার চারপাশ দিয়েই উঠে গেছে দোতলা, সব দোতলারই বারান্দাগুলো থেকে ঠিকরে বেড়িয়ে আসছে হলুদ আলো। উঠোনটা পার করেই একটা বিশাল ঘর। সেখানেই রাখা সদ্য নির্মিত মা দুর্গা। ছোটবেলায় যা প্রায় সব মন্ডপেই দেখা যেত, সেরকমই সাবেকীয়ানার আদলে প্রতিমা।
চারিদিক দেখতে দেখতে এতই অন্যমনস্ক হয়ে পড়েছিল যে ইতিমধ্যেই প্রায় দশ-বারোজন তাদের ঘিরে ফেলেছে লক্ষ্যই করেনি সন্দীপ, প্রকাশ একে একে আলাপ করালো উপস্থিত সবার সাথেই। আত্মীয়স্বজনদের বেশিরভাগই কলকাতায় সেটেলড্, কেউ কেউ দিল্লী, নর্থবেঙ্গল, এমনকি বিদেশেও আছেন। এ বাড়ির দুর্গাপুজোটা যেন তাদের সবার কাছে একটা রি-ইউনিয়ন।
“কি ভাবছিস? অনেক রাত হল, খাবি চল।” -সন্দীপকে সাথে নিয়ে ডানপাশের দোতলাটায় উঠে এল প্রকাশ। সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে গল্প করছিল সন্দীপদেরই সমবয়সী দুজন। প্রকাশকে দেখেই একজন ওর কলার খামচে বলল, “বার বার বললাম দু’দিন আগে আয়, কালই তো ষষ্ঠী। এই দুদিনের প্ল্যান ভেস্তে দিলি তো?”
প্রকাশ কিছু বলতে যাচ্ছিল, তার আগে সন্দীপই শান্ত গলায় বলল, “প্ল্যান করে কি আর সবকিছু হয়? এরথেকে আনপ্ল্যানড কিছুর সাক্ষী থাকলে আনন্দটা কয়েকগুন বেড়ে যায়।”
সন্দীপকে এবার ছেলেটা ভালো করে দেখলো-
“আপনাকে তো ঠিক…”
“আলাপ করিয়ে দিই, এইই সন্দীপ সেন, আমার বন্ধু…”।
সন্দীপ হাত এগিয়ে দিতেই ছেলেটা বুকে টেনে নিল…
“আগে বলবে তো তুমি দিব্যর বন্ধু। আমি সাগর। দিব্যর মাসির ছেলে। আর এ জয়, আমাদের মাসতুতো ভাই।” পেছনে যে ছেলেটা এতক্ষণ শুধুই দেখছিল, সে এবার এসে নিজে থেকেই সন্দীপের গলা ধরে ঝুলে পড়ল, “গুরু, ডায়ালগটা কিন্তু সেরা দিলে। পারলে-জি খেয়েও মানুষ জিনিয়াস হতে পারে, কিন্তু একমাস আগে থেকে প্ল্যান করে কোনো শালা আজ অবধি সাকসেসফুল হয়নি।
”
জয়ের মাথায় একটা চাটি মেরে ওকে নিয়ে নীচে নেমে গেল সাগর। হাসতে হাসতে
সন্দীপরা উঠে এল দোতলার বারান্দায়। বারান্দাটা যেখানে শেষে হয়েছে। সেখানের ঘরে করা হয়েছে সন্দীপদের থাকার ব্যবস্থা। ব্যাগপত্র রেখে হাতমুখ ধুয়ে খেতে এল ওরা। রাতের খাবারের কোনো অসুবিধা হল না। ভাত, দু’রকম ডাল, আলু ভাজা, আলুর দম। প্রয়োজনের থেকে একটু বেশিই খাওয়া হয়ে গেল।
সারাদিন প্রচুর ধকল গেছে। এখন বিছানাটাই সবচেয়ে কাছের। শার্টটা বদলে মোবাইলটা বের করে লকটা খুলল সন্দীপ। প্রায় রাত বারোটা, এর মধ্যেই বাড়িটা যেন ঘুমিয়ে পড়ল।
কাল ভোরে আবার জাগবে। স্টেশনে নেমে ফোন করেছে বাড়িতে, এখন আর করার প্রশ্নই ওঠে না।
প্রকাশ ঘরে ঢুকলো, পরনে সাদা পাঞ্জাবী-পায়জামা।
– কাল সকালে খুব একটা কাজ নেই আমাদের, চাইলে বারান্দায় একটু পায়চারী করতে পারিস।
– বলছি একটা সিগারেট খাওয়া যাবে? খাওয়ার পর একটা লাগে, নয়তো…
– আরে এ জন্যেই তো কোণার ঘরের ব্যবস্থা করা। নইলে তো আমার ঘরেই থাকতে পারতাম।
সন্দীপ হেসে সিগারেটটা ধরালো। বারান্দার আলোগুলো এখন সব নিভিয়ে দেওয়া হয়েছে। শুধু প্রতিমার সামনে একটা একশো পাওয়ারের বাল্ব জ্বলছে। ওতেই চারিদিকের বারান্দাগুলো জুড়ে একটা হালকা হলুদ আভা জন্ম নিয়েছে।
শেষ দু-টান তখনও বাকি। ওদিকে তাকানো মাত্রই সন্দীপ সিগারেটটা নিভিয়ে দিল, তার চোখ আটকেছে ওপাশের বারান্দার কোণাটায়। দু হাত ব্যালকনির রেলিং-এ রেখে নিস্পলক আকাশের দিকে চেয়ে আছে একজন। অন্ধকারেও সন্দীপ যেন স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে, পিঠ অবধি খোলা চুল, সাদা রঙের একটা সুতির চুড়িদার, হাতে সাদা চুড়ি। অস্পষ্ট কিন্তু লাবণ্যে ভরা সে মুখটার দিকে তাকালেই যেন দামামা বাজা শুরু হয়ে যায় মনে। মেয়েটার মুখ থেকেই যেন এমন এক স্বচ্ছ দ্যুতি ঠিকরে বেড়িয়ে আসছে, যা ওই নীচে জ্বলতে থাকা আলোটাকে নিমেষে কুপোকাত করে দিতে সক্ষম।
এভাবেই বেশ কিছুক্ষণ কেটে গেল, তবুও সেই মেয়েটা যেন তার দিকে একবারও খেয়ালই করলো না! কি ভাবছে মেয়েটা?
প্রকাশ অনেকক্ষণ সন্দীপের পেছনে এসে দাঁড়িয়েছে, সন্দীপ কিচ্ছুটি টের পায়নি, তার চোখ এখনও ওদিকে স্থির… এবার মাথা নামিয়ে সন্দীপের কানের কাছে এসে ফিসিফিসিয়ে বলল,
“কি বস্, ঘুমোতে যাবেন না?”
চমকে গেলেও নিজেকে তৎক্ষণাৎ গুটিয়ে নিয়ে সন্দীপ চুপি চুপি ঘরে ফিরে এলো। একটু আলগা হাসি দিয়ে, ট্রেন জার্নির একটু বিবরণ দিয়ে যতটা সম্ভব স্বাভাবিক হওয়ার চেষ্টা করলো…
এদিকে প্রকাশও মেয়েটার ব্যাপারে কিছু বলছে না দেখে একটা কেমন অস্বস্তিও বোধ হলো যেন। একসময় প্রকাশ আর সাড়া না দেওয়ায় অস্বস্তিটা সন্দীপের মাথায় চড়ে বসলো। এপাশ ওপাশ ঘুরলো সন্দীপ।
কে সেই মেয়েটা? প্রকাশেরই আত্মীয় কি? নিস্পলক ওভাবে আকাশের দিয়ে চেয়ে ছিল কেন? এখনও চেয়ে আছে? দু মাইল দূর থেকে কেউ তাকালেও তো মেয়েরা নাকি সব বুঝতে পেরে যায়… তাহলে?
“ভুলভাল না ভেবে ঘুমিয়ে পড়াই ভালো” -বেশ ঘুমজড়ানো গলায় প্রকাশ কথাটা বলে ওদিক ফিরলো।
সন্দীপ যেন আর নড়তে পারছে না, খুব আস্তে আস্তে শ্বাস নিচ্ছে। ঘাম দিচ্ছে শরীরে…
সন্দীপ কি লজ্জা পেয়েছে? নাকি প্রকাশ শুনতে পেয়েছে তার বুকের ভেতর বাজতে থাকা সেই দামামাটা!
হাজার অস্বস্তির মাঝেও হঠাৎ যেন কোথা থেকে একটা দীর্ঘশ্বাস ধেয়ে এল, ভেতর কাঁপিয়ে একটাই তরঙ্গ তুলে বাইরে এসে ছড়িয়ে ছিটিয়ে গেল চারিদিক- ‘কে সেই মেয়েটা?!’