“এই সন্দীপ ওঠ, আর কতক্ষণ ঘুমোবি? এই বাঁ…”
প্রকাশের কথায় ঘুম ভেঙে একরকম লাফিয়েই উঠলো সন্দীপ। মোবাইলটা বের করে দেখলো, প্রায় আটটা! ব্রাশটা হাতে নিয়ে ছুটলো বাথরুমের দিকে। হাতমুখ ধুয়ে, স্নান সেরে যখন ঘরে ফিরলো, তখন সাড়ে আটটা বেজে গেছে। নীল জিন্সের উপর হলুদ রঙের একটা পাঞ্জাবী গায়ে জড়িয়ে সিঁড়ি দিয়ে নীচে নেমে আসতে আসতেই অবাক হয়ে গেল সে, অ্যাত্তো লোক? কাল খুব বেশি হলেও কুড়ি জনকে দেখেছে সে। আজ সংখ্যাটা পঞ্চাশ ছাড়িয়ে গেছে। দেবীর বোধনের তোরজোড় চলছে এখন, সবাই খুব ব্যস্ত। চেনাজানা কাউকেই দেখতে পাওয়া যাচ্ছে না। প্রকাশও যে কোথায় চলে গেল, কে জানে! সিঁড়ি দিয়ে নেমে উঠোন পেরিয়ে বাইরে এল সন্দীপ।
বাইরে একটা ছোটখাটো প্যান্ডেল করা হয়েছে, রাতে নজরে পড়েনি। ইতিমধ্যেই মেন গেটটার পাশ দিয়ে সাজানো হয়েছে প্লাস্টিকের চেয়ার। ওদিকে একটা বাচ্চা ছেলের দল গল্প জুড়েছে, গোল হয়ে। এদিক সেদিক ঘুরে কিছু মাঝবয়সী ভদ্রলোক তদারকি করছেন, গেটের সামনের দিকের চেয়ারগুলো ফাঁকা। ওর মধ্যে থেকেই সন্দীপ বসল একটায়। মোবাইলের লকটা খুলে ডাটা অন করার সাথে সাথেই ফোন জুড়ে যেন নোটিফিকেশনের বন্যা বয়ে গেল। চেনা অচেনা প্রচুর মানুষ শারদ শুভেচ্ছা পাঠিয়েছে হোয়াটসঅ্যাপ আর ফেসবুকে। বন্ধুদের গ্রুপটায় কে কোন ড্রেস পরবে তা নিয়ে একটা গুরুত্বপূর্ণ মিটিং চলছে।
বাকি ম্যাসেজগুলো স্ক্রল ডাউন করেই থমকে গেল সে। অপর্ণা তাকে শারদ শুভেচ্ছা পাঠিয়েছে! ব্যাপারটা খুবই আনএক্সপেক্টেড। সম্পর্ক শেষ করে এখন আবার শারদ শুভেচ্ছা কেন? মন খারাপ হয়ে গেল ওর। কত করে ভেবেছিল আজকের দিনটার জন্যে। অপর্ণার সাথে আজ সম্পর্ক থাকলে সন্দীপকে এখানে আসতে হতো? যে যতই বলুক, পুজোর সময় বাড়িই যেন স্বর্গ। পাড়ার প্যান্ডেল, স্কুলের বন্ধুবান্ধব, ছোটবেলার ক্রাশ, মায়ের
হাতের রান্না… সুইটজারল্যান্ডের ফ্রি ট্যুরও যেন এর কাছে নস্যি। মানুষ পুজোর সময় বাড়ির বাইরে থেকে যে কি শান্তি পায় ভগবান জানে। এখানেও তো কত লোক, কিন্তু পুজো পুজো ভাবটা আর কই? কিন্তু সন্দীপের সামনে দিয়েই অপর্ণা প্রসুনের হাত ধরে ঘুরবে এটাও সন্দীপের পক্ষে মেনে নেওয়া প্রায় অসম্ভব। ব্রেক-আপের পর সন্দীপ কয়েকদিন ঘুমোতে পারেনি প্রসুনের সাথে ওকে কল্পনা করে। আর সেটাই যখন বাস্তবে ঘটবে…
চোখ বুজে এল সন্দীপের। মুখ দিয়ে অস্ফুটে বেড়িয়ে এল- ‘বালের ভালোবাসা!’
“কি ভাবছেন তখন থেকে?”
, সন্দীপ চমকে গিয়ে চোখ খুলতেই চারিদিক হঠাৎ কেমন যেন শান্ত হয়ে গেল। বাচ্চা ছেলের দলটার হাসিঠাট্টা আর কানে আসছে না, ওকে যেন শূন্যে ভাসিয়ে দিয়েছে কেউ। আবার দামামা বাজতে শুরু করেছে বুক জুড়ে। সেই মেয়েটা! হ্যাঁ গতকালের সেই মেয়েটা এখন তার সামনে দাঁড়িয়ে। লাবণ্য যেন তার চোখ ঠিকরে বেড়িয়ে আসছে। কাজলমাখা চোখ দুটো তার দিকে এখন নিস্পলক তাকিয়ে… সন্দীপও যেন চোখ ফেরাতে পারছেনা, মোবাইলটা হাতে ধরে হতভম্ব হয়ে চেয়ারটায় বসে…
“আপনি কথা বলতে পারেন না?”
মেয়েটার চোখে ঠাট্টা মেশানো। সন্দীপ এবার প্রাণপনে সম্বিৎ ফিরিয়ে বেসুরো গলায় বলল,
– “হ্যাঁ? হ্যাঁ, পারি।”
– কংগ্র্যাটস্!
– কিসের জন্যে?
– এই যে বললেন, কথা বলতে পারেন, তাই… বলেই খিলখিলিয়ে হেসে উঠলো মেয়েটা।
লজ্জায় কান লাল হয়ে গেল সন্দীপের, মেয়েটা তাকে নিয়ে রীতিমতো ঠাট্টা করে যাচ্ছে… আর ব্যাপারটা এতই অপ্রস্তুত যে চুপ করে তার হাসি শোনা ছাড়া উপায়ও নেই।
– বসতে পারি? -মেয়েটার চোখে আবার সেই লাবণ্য।
– হ্যাঁ বসুন না। বলেই একটা চেয়ার এগিয়ে দিল সন্দীপ।
– বলবেন না?
– কি?
– কি ভাবছিলেন?
– হ্যাঁ? মানে না, কিছু না।
– বুঝেছি, বলতে চান না, তাই তো?
– না সেরকম কোনো ব্যাপার নেই।
– বুঝলাম। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল মেয়েটা।
– আপনি? মানে আমি সন্দীপ, প্রকাশের বন্ধু। প্রথমবার এলাম এখানে, কাউকে তো ঠিক চিনি না, তাই মানে…
– কে প্রকাশ?
– প্রকাশকে চেনেন না আপনি? এ বাড়ির ছেলে।
– কি জানি, হবে হয়তো।
– তাহলে আপনি এ বাড়িতে…
– আমার দিদি এ বাড়ির রিলেটিভ। প্রতিবারই জোর করে এখানে আসার। এবার আসতেই হল।
– আচ্ছা বেশ।
– আর কিছু জিজ্ঞেস করবেন না? মেয়েটার চোখে আবার ঠাট্টা জায়গা নিয়েছে…
– না মানে, কি জিজ্ঞেস করবো?
– বাকি ছেলেরা যেমন জিজ্ঞেস করে, নাম, ফোন নাম্বার ইত্যাদি ইত্যাদি। তারপর সুযোগ বুঝে…
মাথায় রাগ চড়ে গেল সন্দীপের। বাচ্চা ছেলের মতো চিৎকার করে উঠলো,
– আপনি যেমন ভাবছেন, তেমনটা আমি নই!
– এ তো সব ছেলেদেরই কমন ডায়ালগ।
– আশ্চর্য! বলছি তো অমনটা নই।
– তাহলে কাল রাতে অমন ড্যাব ড্যাব করে চেয়েছিলেন কেন?
কথাটা শোনামাত্রই সন্দীপের ভেতরে জেগে ওঠা বাঘটা ভেজা বেড়াল হতে সময় নিল না। আমতা আমতা করে বলল- “আপনি? মানে আপনি তো তাকাননি! আপনি কীভাবে…”
আবার সেরকম খিলখিলিয়ে হেসে উঠলো মেয়েটা। এই হাসিটা যেন সন্দীপকে এক নিমেষে একশো টুকরো করে দিতে পারে।
লজ্জায় থম মেরে বসে রইল সন্দীপ চেয়ারটায়। প্রকাশ যে কোথায় গেল? আর গতকাল পরিচয় হওয়া ওই দুটো ছেলেরও তো দেখা পাওয়া যাচ্ছে না।
– আপনি কবিতা টবিতা লেখেন নাকি? আবার ভাবনায় ডুবে গেলেন যে…
– না মানে, আমি একটু জল খাবো।
– জল?- আবার সেই হাসি।
সন্দীপ চেয়ার ছেড়ে যখন উঠে এল, মেয়েটার হাসি তখনও কানে বাজছিল। সত্যিই মেয়েরা অনেক বেশি শক্তিমান। দুর্গা অসুরকে ওভাবে বধ করতে গেল কেন? পাশে বসে মিষ্টি ভাবে এরকম দুটো কথা বললেই তো অসুরের টিক্কিটিও পাওয়া যেত না কোনোদিন। তবে আর যাই হোক, সময় তো কেটে গেল। কথাগুলো ভেবে যেন এখন হাসি পাচ্ছে খুব।
নাহ, মেয়েটার মধ্যে একটা অন্যরকম ব্যাপার আছে।
“দাঁত ক্যালাচ্ছো কেন গুরু?” -জয়কে দেখতে পেয়েই সন্দীপ নিজেকে সামলে নিল- “না মানে, এমনিই…”।
সন্দীপকে দেখতে পেয়ে প্রকাশ আর সাগরও ওর দিকে এগিয়ে এসে বলল, “কিরে? কোথায় ছিলিস?”
– বাইরে বসেছিলাম, মেয়েটাও ছিল।
‘মেয়ে?’ বলেই তিনজন অবাক হয়ে তাকালো ওর দিকে…
জয় বলল- ‘কোন মেয়ে গুরু?’
সন্দীপ একটু অপ্রস্তুত হল- ‘একটা মেয়ে’।
‘আরে সে তো বুঝলাম, কী নাম? কোথায় থাকে? কীভাবে আলাপ হল? -প্রকাশের চোখ সন্দীপের দিকে।
– জানি না।
– এতক্ষণ ধরে বসে বসে তবে কি ছিঁড়লি?
সন্দীপ এবার নিজের মনেই বিড়বিড় করে উঠলো- ‘সত্যিই তো, কি ছিঁড়লাম? মেয়েটার ব্যাপারে তো কিছুই জানা হল না।’
– হাঁ করে দাঁড়িয়েই থাকবি? নাকি কিছু বলবি মেয়েটার ব্যাপারে।
– আরে, কাল রাতে ওদিকের বারান্দায় যে মেয়েটা দাঁড়িয়ে ছিল, সাদা সালোয়ার পরে…
– কোনদিকের বারান্দায়? আমি তো কোনো মেয়েকে দেখিনি।
– আরে মানে গতকাল রাতেই তো দেখলাম ওদিকের বারান্দায়, খুব সুন্দর দেখতে।
– আরে কোন মেয়ের কথা বলছিস তুই?
– আরে ওর দিদি নাকি এ বাড়ির রিলেটিভ।
– কি নাম দিদির? কোন রিলেটিভ?
– জানি না।
এতক্ষণ চুপ থেকে এবার জয় বলল- ‘বুঝলে গুরু, গ্লু কনডিতে এনার্জি আর এ বাড়িতে এখন তার সেই রিলেটিভ দিদিকে খুঁজে বের করা ভীষণ মুস্কিল।’
প্রকাশ কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল। সাগর থামালো, “যা সন্দীপ খেয়ে নে, ততক্ষণ আমরা একটা কাজ মিটিয়েই আসছি।”
সন্দীপ উপরে উঠতে উঠতে শুনলো প্রকাশরা হো হো করে হেসে চলেছে…
কিন্তু সেদিকে এখন তার কোনো উৎসাহ নেই, সে নিজেকে একটাই প্রশ্ন করে চলেছে বারবার- ‘কে সেই মেয়েটা?…কে সেই মেয়েটা?’