আজ আমি যাচ্ছি আমার নতুন বাসায়। এ বাসায় আজ আমার শেষ দিন। ধূপকাঠির গন্ধটা বড্ড তীব্র। মাথাটা ধরে গেল। তাও ভাগ্যিস রজনী গন্ধটা আনেনি। ওটা আমার বরাবরের অপছন্দের। সামনের বাগানে আমার লাগানো সাদা ফুল গাছটা এবার চাপ চাপ ফুল ধরেছে। দীপকে মজার ছলে গাছটা লাগানোর সময় বলেছিলাম, এই এই গাছটাই ফুল ধরলে আমার শেষ যাত্রা এর ফুলে সাজাবি। ওর কথাটা মনে আছে হয়তো। শব-যাত্রায় মানুষ সাদা কাপড় কেন দেয়, তার উত্তর আমি আজও খুঁজছি। তবে যাই হোক অনেকদিন পর গায়ে একটা নতুন কাপড় পরলো। টাকা নেই এমনটা তো নয়।
ব্যাংকে কারি কারি জমে আছে। কিন্তু কিনে দেওয়ার লোক নেই। আবদার করার লোকও নেই। আবদারের কথা বলতেই বাবুর কথা মনে পড়ে গেল। প্রতিবার পৌষ মেলায় গিয়ে তার আবেদরের শেষ থাকত না তার। যতক্ষণ পর্যন্ত না দুই হাত ভর্তি হত, বাড়ি ফিরত না কিছুতেই। আবদার তো সবই মিটেছিলাম ওর। এমনকি যখন বিদেশে পড়তে যেতে চাইছে, নিজের সামর্থের বাইরে হওয়ায় বেহালার পঁয়তাল্লিশের এক নাম্বার বাড়িটা বন্ধক করে দিলাম। তখন যদি জানতাম! সবার বলে ছেলে বিদেশে গেলে আর ফিরে না। বাবুও তাই করতে পারত।
তাহলে মিটে যেত। দু’চারটে ভিডিও কলে, সব আশা-প্রত্যাশার নিরসন ঘটত। কিন্তু ফিরে এসেই অনিষ্ঠটা বাঁধালো। ফিরে এসেছে ছেলে, তো ভাবলাম এবার তো সব সমস্যার সমাধান করবে ও। আবার চিন্তাহীন ঘুমে নিশ্চিন্ত জীবন পাবো। কিন্তু সেকেলে বাড়ি আর সেকেলে বাবা-মা কোনটাই বিদেশ ফেরত ছেলের মনে ধরে না আর। আমারও মেরুদন্ড শক্ত। তাই স্ত্রী মারা যাওয়ার পর স্থাবর-অস্থাবর সব বেঁচে আমি চলে এলাম এই নতুন বাসাতে। বেশ ভালোই ছিলাম এখানে। বাসা বলছি কারণ ভালোবাসার কোনো অভাব ছিল না এখানে।
বাদ সাধলো হার্টের অসুখ। বাড়াবাড়ি হওয়ায় হাসপাতালে ভর্তি হতে হলো। লোকলজ্জার ভয়ে ছেলে তখন অসুস্থ বাবাকে আবার তথাকথিত বৃদ্ধাশ্রমে পাঠাতে না পেরে বাধ্য হয়েই নিজের বাড়িতে নিয়ে গিয়ে ঢোকালো। তারপর যেটুকুও ছেলের প্রতি ভক্তি-ভালোবাসা ছিল, সব চলে গেল চিরতরে। অবহেলা কটুক্তি শুনতে শুনতে আমার বাবুর মুখটাও দেখতে আর ইচ্ছা করত না শেষদিকে। তাই সহ্য করতে না পেরে বাবুকে ত্যাজ্য করেই, আবার ফিরিয়ে এলাম সাধের বাসায়। কিন্তু সেও আজ ছেড়ে যাওয়ার পালা। সবাই কেন যে বাবুকে ডাকতে চাইছে? আমি জানি ও কোনদিনও আসবেনা। ছেলের ওপর একবার বাবার অভিমানের বরফ বলতে পারে, কিন্তু কোনদিনও বাবাকে ছেলেরা ক্ষমা করতে পারে না। আমার এসব আর ঘুড়ে দেখার সময় নেই। সব মান অভিমান ত্যাগ করে চললাম আর এক নতুন বাসার খোঁজে।
কলমে: মৌমিতা ভাওয়াল দাস।