“আছে যত সেরা মিষ্টি এল বৃষ্টি এল বৃষ্টি”
সেই গুপীবাঘার কথা মনে আছে নিশ্চয়ই, যুদ্ধের সম্মুখসমরে হাল্লারাজার সেনাকে থামাতে সুরে মায়া যথেষ্ট ছিলনা। শেষবেলায় নামাতে হয়েছিল মিষ্টির বৃষ্টি। সেই তখন থেকেই সম্পর্কের শীতলতা ভেঙে, উষ্ণতা আনতে মিষ্টিই রাজা হিসেবে কাজ করে।
বাঙ্গালীর মিষ্টির ইতিহাস বহু পুরনো। নবাবকালীন সেই ইতিহাস থেকে আজও ঐতিহ্যবাহী মিষ্টির যোগসূত্র বর্তমান।
এ রকমই এক জেলার, শহরের মিষ্টির উপাখ্যান তুলে ধরতে চলেছি যার বুকের ভাজে ভাজে রয়েছে ঠাসা ইতিহাস। চিত্রপটে আঁকা আছে নবাব নবাবীর কাহিনী, আছে যুদ্ধ, প্রেম, বিশ্বাসঘাতকতা, বন্ধুত্বের উপাখ্যান। যে জায়গার কথা বলা হচ্ছে তা হল ইতিহাস মোড়া মুর্শিদাবাদ। আর এই নবাবের ইতিহাসের সাথে জড়িয়ে আছে ‘মিষ্টি’ উপাখ্যান। শিল্প, চিত্রকলা, ভাস্কর্য, ছাড়াও মিষ্টির জন্যও খ্যাত মুর্শিদাবাদ। এই মিষ্টি -এর নাম ছানাবড়া, যার উদ্ভব সেই নবাবী আমল থেকেই।
তবে এই সৃষ্টির ইতিহাসের পিছনে দুটি কিংবদন্তী প্রচলিত রয়েছে। স্মৃতিপটে পথ ধরে চলে যাওয়া যাক প্রায় 200 বছর আগে। মুর্শিদাবাদ জেলার লালবাগ শহরের প্রথম এই মিষ্টির আবির্ভাব। লালবাগের একটি আদি মিষ্টির দোকানের মালিক ছিলেন নিমাই মন্ডল তারই হাত ধরে এই ছানাবড়ার পথ চলা শুরু হয়েছিল।
একমন বা দেড়মন সাইজের ছানাবড়া বানানো হতো তখন। সেই দোকান থেকে নবাবের প্রাসাদে সরাবরাহ করা হতো ছানাবড়া। অতিথি অভ্যর্থনা জানাতে রুপোর থালায় সেই খাটি ঘিয়ে ভাজা ছানাবড়া শোভা বর্ধন করত। শুধু দেখতে সুন্দর বলে নয় স্বাদেও ছিল অনন্য। অতিথিদের রসনাতৃপ্তিতে ছানাবড়া ছিল সেরার সেরা। বাংলার কেক নামে আখ্যা পেয়েছিল এই ছানাবড়া।
তবে এও কথিত আছে 200 বছর আগে এখানের কাশিমবাজারের রাজা ছিলেন শ্রী মনীন্দ্রচন্দ্র নন্দী। তার ভাবনাতেই নাকি সৃষ্টি হয়েছিল ছানাবড়ার। হঠাৎ রাজার ইচ্ছে হয় সাহেবদের কিছু উপহার দেওয়ার। বরাবরই যেকোনো সুসম্পর্ক বজায় রাখতে পরিবারে বয়োজ্যেষ্ঠ সদস্যের মতো প্রধান সদস্য হয়ে মিষ্টিই সেই গুরুদায়িত্ব পালন করে। আর তারমধ্যেও যদি কোনো নতুনত্ব আনা যায় তাহলে তো আর কথায় নেই। ব্যাস যেমন ভাবা তেমন কাজ…
এরপরে রাজা আদেশ দিলেন কারিগরদের। খাগড়া সোনাপট্টি এলাকার প্রসিদ্ধ মিষ্টি ব্যবসায়ী পটল ওস্তাদ মিষ্টি তৈরীর বরাত পেলেন। ছানা কে ঘি ময়দার সমন্বয়ে ভেজে তাকে গাঢ় রসে ফেলে তৈরি করলেন এক নতুন মিষ্টি। সেই মিষ্টি ইংরেজদের উপহার দিলেন। আর তা মুখে পুরতেই অপূর্ব স্বাদের মোহজালে মাত হলেন তারা। ছানা কে ঘি দিয়ে ভাজায় নাম দেওয়া হলো ছানাবড়া।
“যেন সে ভারী গুরুগম্ভীর,
মনেহয় তার শক্ত আবরনে
আদপে মনটি তার বেজায় নরম,
রসে টইটম্বুর এক কামড়ে।”
ঘটনা যেটাই হোক নবাবকালের বা রাজার আমলের খানাতেও যে নবাবীয়ানা থাকবে এতো স্বাভাবিক ব্যাপার। তবে 200 বছর পেরিয়েও সেই ঐতিহ্যবাহী ছানাবড়ার জনপ্রিয়তা কিন্তু ম্লান হয়নি। সাইজের দিকে বিবর্তন এসেছে বটে কিন্তু মুর্শিদাবাদের প্রায় সর্বত্র বহরমপুর,খাগড়ার প্রায় প্রতিটি দোকানে অন্যান্য মিষ্টি- এর পাশে ছানাবড়া শোভা পাবেই।
সমুদ্রমন্থন করে দেবতাদের অমৃত আনার গল্প কমবেশি সকলেই জানি। সেই অমৃত কেমন খেতে ছিল সে বিষয়ে না জানলেও বাঙালীর কাছে মিষ্টি- এর স্বাদ অমৃত সমান। বাঙালির রসনা বাসনা তৃপ্তিতে মিষ্টি জায়গা কেউ নিতে পারেনি।
শুধু কি এই আমজনতা এই ছানাবড়ার স্বাদে অভিভূত হয়েছিলেন আমাদের দেশনায়ক নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসুও। 1938 সালে বহরমপুর থেকে একমন ওজনের ছানাবড়া উপহার দেওয়া হয়েছিল যা পেয়ে অত্যন্ত আনন্দিত হয়েছিলেন তিনি। 1998 সালে স্বামী বিবেকানন্দের জন্য বহরমপুর থেকে স্বামী অখন্ডানন্দ ছানাবড়ার নিয়ে গিয়েছিলেন সেকাল থেকেই আজ পর্যন্ত এইধারা এখনো অক্ষুন্ন আছে। আজও কোনো বিশিষ্ট ব্যক্তি মুর্শিদাবাদে এলে পেল্লাই সাইজের ছানাবড়া দিয়ে অভ্যর্থনা জানানো হয়।
এটাও পড়তে পারেন: প্রনয় আমর্শে প্রতিধ্বনি: এক প্রতিধ্বনির গল্প
সাধারন মানুষের ক্ষেত্রের অথিতি আপ্যায়ন হোক বা আত্মীয়ের বাড়িতে উপহার নিয়ে যাওয়া কিংবা হোক পুজো শেষে বিজয়া বা বাড়িতে কনে দেখা সগৌরবে রসগোল্লার পাশে নিজের মর্যাদা নিয়ে অক্ষুন্ন আছে ছানাবড়া। মুর্শিদাবাদ এসেছে অথচ এই মিষ্টি খেয়ে যায়নি এমন মানুষ পাওয়া দুষ্কর। সেই নবাবী আমল থেকেই নবাবের মতোই নিজের ধারা অক্ষুণ্ণ রেখে চলেছে ছানাবড়া।