প্রিয় শিক্ষক

ইংরাজি মাধ্যমের এক বেসরকারি স্কুলে আজ ধুমধাম করে টিচার্স ডে সেলিব্রেট হচ্ছে। কত প্রোগ্রাম হবে। প্রথমে প্রিন্সিপালের এই দিনের গুরুত্ব সম্পর্কে বক্তৃতা তারপর বিনোদনধর্মী বর্নাঢ্য অনুষ্ঠান। ইংলিশ গান, বাচ্চাদের নাচ, পোয়েট্রিস আরও কত কি! এরজন্য আধুনিক বাবা মাদের চিন্তার শেষ নেই। কেউ নিজের ছেলেমেয়েদের নাচের ড্রেস পরাতে, মেকআপ করতে ব্যস্ত আবার কেউ ক্রমাগত রিহার্সাল করিয়ে যাচ্ছেন।
গতকাল আবার “মাই ফেভরিট টিচার” নিয়ে একটা প্রবন্ধ প্রতিযোগিতা হয়েছে। আজ তার রেজাল্ট। প্রতি ক্লাসের বিজয়ীদের পুরস্কৃত করা হবে।

অবশেষে এল সেই সময়। প্রিন্সিপাল ফলাফল ঘোষনা করবেন। সবার মধ্যে টানটান উত্তেজনা। মাইকে নিজের সন্তানের নামটা শোনার জন্য সবাই অপেক্ষায়। জেলাশাসকের হাত থেকে পুরস্কার বলে কথা, ইঁদুর দৌড়ে নিজেদের সবার আগে রাখতেই হবে।
প্রিন্সিপাল ফলাফল ঘোষনা করলেন। একটি ছেলে সবার মন জয় করে নিল। ক্লাস ফোরের ছাত্র মৃন্ময় ব্যানার্জী। ডাকনাম টুবাই। সে তার ফেভারিট টিচার হিসেবে নিজের ‘মা’কে বেছে নিয়েছে। তার লেখা শুনে উপস্থিত সকলেই মন থেকে হাততালি দিয়ে উঠল। সত্যিই সবাই একবাক্যে মেনে নিল সেই পুরস্কারের দাবী রাখে। টুবাইও পুরস্কার হাতে ছুট্টে বাড়ি চলে এলো মাকে দেখাবে সে আজ কত বড়ো সম্মান পেয়েছে, সে তার প্রিয় শিক্ষকের স্বপ্ন পূরন করতে পেরেছে। সকলের মন জয় করে বিজয়ী হয়েছে।

– “মা মা দেখো তুমি বলতে একদিন আমি অনেক বড়ো হবো, সবাই আমার নাম করবে, কিন্তু তুমি তো তারজন্য আমাকে একটুও আদর করলে না, ও মা মা, কথা বল না মা।”- কাতর ভাবে কথাগুলো টুবাই রজনীগন্ধা ফুলের মালা পরানো মায়ের ছবির সামনে বলে উঠল। একবছর আগে একটা অসুখে ওর মা মারা যায় কিন্তু ও মাকে এক মুহূর্তের জন্যও ভুলতে পারেনি। তার ছোট্ট আঙুল ধরে মা একটু একটু করে ওকে বড় করেছে, নিজের হাতে ভালমন্দের পার্থক্য শিখিয়েছে। তাই মা ই ওর কাছে প্রথম ও শ্রেষ্ঠ শিক্ষক। প্রতিটি সন্তানের কাছে একজন মায়ের চেয়ে শ্রেষ্ঠ শিক্ষক কেউ হতে পারে না। তাই টুবাই সবার থেকে ভিন্নভবে লিখেছে।
তার শিশুমনের সরল লেখা কারো কারো চোখে জল এনে দিয়েছিল।

সে লিখেছে– “আমার ফেভারিট টিচার আমার মা। যে আমাকে আদর করে, দুষ্টুমি করলে বকাও দেয়। আমার কোন কাজে মা কষ্ট পেলে মা বলত আমায় ছেড়ে অন্যদেশে চলে যাবে। সেই ভয়ে আমি কোন দুষ্টুমি করতাম না। মা আমায় বড়দের শ্রদ্ধা করতে আর সবাইকে ভালবাসতে শিখিয়েছে। মার স্বপ্ন বড় হয়ে আমি যাই হইনা কেন আগে মানুষের মতো মানুষ হব। কি জানি মা এমন কেন বলত আমি তো মানুষই আছি আবার নতুন করে কি করে মানুষ হবো। ঘুমানোর আগে মা আমার কপালে চুমু খেয়ে বলত “ভয় পেও না আমি তো আছি।” আমার অন্ধকারকে খুব ভয় তাই মায়ের হাত শক্ত করে ধরে শুয়ে থাকতাম। আর ভয় করত না কিন্তু এখন আমি মার উপর খুব রেগে আছি। আমি কোন দুষ্টুমিও করিনি। তাও মা আমায় ছেড়ে অন্যদেশে চলে গেল। কেন মা? তোমার কি আমার কথা একটুও মনে পরে না? তুমি যে বলতে কথা দিয়ে কথা রাখতে হয়! তাহলে রাতে যখন আমি ভয় তুমি আর আসোনা কেন? এক বছর আগে সেদিন তোমার খুব শরীর খারাপ ছিল। আমায় জোর করে স্কুলে পাঠালে। ফিরে এসে তোমায় আর দেখতে পেলাম না। সবাই বলল তুমি আকাশের তারা হয়ে গেছো। আমি রোজ আকাশে তোমায় খুঁজি। কোনটা তুমি মা?”

এইটুকু পড়ে প্রিন্সিপাল থেমেছিল। দর্শকের অনেকে চোখে তখন জল কিন্তু টুবাই পুরস্কার নেবার সময় একটুও কাঁদেনি। শুধু আকাশের দিকে একবার তাকিয়ে তার প্রিয় টিচারকে খুঁজে নিয়ে বলল- “আমার প্রিয় শিক্ষক, এবার তুমি আমার জন্য গর্ববোধ করবে তো!”
(সমাপ্ত)

 

Facebook Comments Box

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *