দুপুর বারোটা। বালিগঞ্জ ফাঁড়ি।
সকালের বৃষ্টির পর এখন একটা ভ্যাপসা গরম পড়েছে। রাস্তার ডিভাইডারের ওপর দাঁড়িয়ে বছর নয়ের বলাই। একটা তেলচিটে হাফপ্যান্ট আর স্যান্ডো গেঞ্জি পড়া ছেলেটার রঙ শ্যামলা। কিন্তু বড় বড় উজ্জ্বল চোখদুটি অদ্ভুত মায়া ধরানো। মিনিট দুয়েক পরই সিগনাল সবুজ থেকে লাল হল। একে একে ব্যস্ত কিছু বাস আর দামি-কমদামী বিভিন্ন গাড়ি সারি করে রাস্তার ওপর দাঁড়িয়ে পড়ল। সঙ্গে সঙ্গে বলাইও রাস্তায় নেমে পড়ল। হাতে একটা হলুদ বাক্সে ধুপকাঠির প্যাকেট। পেছন দিকের দু-তিনটে গাড়ীর সামনে গিয়ে মুখস্থ বুলির মতো চেঁচাতে লাগলো, “ধুপকাঠি… ধুপকাঠি…”। বন্ধ কাচের ভেতর থেকে দু-একজন ওর দিকে তাকিয়েও মুখ ফিরিয়ে নিল। বলাই সামনে দাঁড়িয়ে থাকা বড় দুধসাদা রঙের গাড়িটার জানালার কাছে গিয়ে দাঁড়ালো। সামনের সিটে একজন মাঝবয়সী লোক আর পেছনে একটা মেয়ে, বলাইয়ের মতই বয়স হবে আর একটা মহিলা বসে। মেয়েটার মা হয়তো। বাচ্চা মেয়েটা বলাইয়ের দিকে তাকিয়ে ছিল। বলাই জানলা দিয়ে একটা ধুপকাঠির প্যাকেট হাতে নিয়ে বলল, “ নাওনা গো। একটা পাঁচটাকা। নাওনা একটা…” ভেতর থেকে মহিলা বলল, “ না লাগবে না। যা এখান থেকে…”। বলাই শেষ চেষ্টা করলো, “ সকাল থেকে কিছু খাইনি গো… একটা নাও… ধুপটার খুব ভাল গন্ধও… নাওনা…”। ঠিক তখনই বলাই হাততালির আওয়াজ পেল পেছন থেকে। বলাই খুব ভাল করে চেনে আওয়াজটা। হিজরা বলে এদের, ওরাই এরকম হাততালি দেয়। একটা লাল-হলুদ রঙের কটকটে শাড়ি, ঠোঁটে লাল লিপস্টিক, কপালে টিপ পড়া একজন এসে হাত পাতল গাড়িটার জানালার কাছে। “দে না মা… দে” বলার পর দ্বিতীয়বার হাততালি দেওয়ার আগেই ভেতরের মহিলা ব্যাগ থেকে একটা দশ টাকার নোট বার করে হাতে দিল ওর। বাচ্চা মেয়েটির মাথায় একবার হাত ছুঁইয়ে চলে গেল সে। বলাই তখনও গাড়ীর জানালার আধখোলা কাচটায় হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে। কিছু না বলে অবাক চোখে তাকিয়ে আছে ভেতরের দিকে। গাড়ীর কাচটা বন্ধ হচ্ছিলো। হঠাৎ আঙ্গুলে চাপ পড়তেই সম্বিত ফিরল বলাইয়ের। হাতটা সরিয়ে নিতে নিতেই গাড়িটা চলতে শুরু করলো। একরাশ চলন্ত গাড়ীর মাঝে রাস্তায় একা দাঁড়িয়ে বলাই। গতিময় গাড়িগুলির মাঝে বলাই তখন আকাশের দিকে তাকিয়ে। তেজি সূর্যটার দিকেও তাকিয়ে আছে অনায়াসে।
“কিরে এত তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরলি…” ফুটপাথের ওপর কাঠের উনুনে ভাত চাপাতে চাপাতে বলল বলাইয়ের মা। বলাই এসে বসল ফুটপাথে। ধুপকাঠির প্যাকেটের দিকে চোখ পড়তেই মা বলল, “একটাও তো বেচিসনি, বাড়ি ফিরে এলি কেন…” বলাই উত্তর দিল না। “ কিরে কি হয়েছে তোর… নে জল খা। আমি ভাতটা দেখিগে…” মিনিট পাঁচেক পর মায়ের কাছে এসে বসল বলাই। “ও মা শোন… আমায় একটা শাড়ি পড়িয়ে দেবে?”। মা হাসতে হাসতে বলল, “কেন রে, শাড়ি পড়বি কেন?”। বলাই বলল, “আমাকে একটা শাড়ি আর ঠোঁটে রঙ লাগিয়ে দাও। তাহলে আর ধুপকাঠি বিক্রি করতে হবে না… হাত পাতলেই টাকা পাবো। এই ধুপের বাক্স বইতে ভাল লাগেনা আর…”। বলাইয়ের মায়ের চোখ দিয়ে অঝরে জল পড়ছে… মুখে রা নেই… বলাই বলল,
“ও মা… মা… আমি হিজরা হবো…”।।