বিজয়ী হবো পরাজিত নয়
আজকের গল্পটা একটু অন্যরকম— কিছুটা মানসিক বাকিটা হরমোনাল। না, জীববিদ্যার কোনো বিষয় নিয়ে আলোচনা করবো না। তবে মানব জীবনে বিজয়ী বা পরাজিত হওয়ার পিছনে এর প্রভাব অনেকটাই আছে। বিষয়টা হল অনুপ্রেরণা কিন্তু মন আর হরমোনের সাথে এটার সম্পর্ক অনেকরই বোধগম্য হবেনা। আসলে অনুপ্রেরণা জিনিসটা না ঠিক কিছুটা কেমিস্ট্রির রিয়েকশ্যানে অনুঘটকের মতন, আবার আগুন জ্বালাবার সময় অক্সিজেনের মতন।
জীবনের যেকোনো কঠিন পদক্ষেপ নেওয়ার বা যেকোনো বড়ো বিপদ পেরোবার আগের প্রেক্ষাপটটা যেন কোনো সিনেমার ক্লাইম্যাক্স তবে এখানে হিরোটা আমরা নিজেরা হই এটাই যা পার্থক্য। কিন্তু ওই সাধারণ মানুষ থেকে হিরো হওয়ার কোনো একটা নির্দিষ্ট কারণ থাকে যেটা কখনো সাময়িক পরিস্থিতি হয় কখনো বা কোনো ঘটনার প্রভাব আবার কখনো কারুর উপস্থিতি বা অনুপস্থিতি বলা যায়। এককথায় বললে ওই কারণগুলোই হয় আমাদের জীবনের অনুপ্রেরণা। কিন্তু এটা ঠিক কীভাবে কাজ করে সেটা একটু দেখে নেওয়া যাক।
অরুণিমা সিনহার কথা অনেকেই শুনেছেন নিশ্চয়ই, গ্রামের মেয়ে অরুণিমা খুব গরীব পরিবার থেকে এসেছিল। তিনি একটি জাতীয় স্তরের ভলিবল খেলোয়াড় ছিলেন, যিনি ২০১১ সালে কিছু ডাকাতের দ্বারা একটি চলমান ট্রেন থেকে ধাক্কা খেয়ে নীচে পড়ে গেছিলেন যখন তিনি তাদের প্রতিরোধ করছিলেন। ফলস্বরূপ, তার এক পায়ের হাঁটুর নিচের অংশ ট্রেনে কাটা পড়ে যায়। যখন তিনি অল ইন্ডিয়া ইনস্টিটিউট অফ মেডিক্যাল সায়েন্সেসে চিকিৎসা করাচ্ছিলেন, তিনি মাউন্ট এভারেস্ট চড়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন।
তিনি ক্রিকেটার যুবরাজ সিং (যিনি সফলভাবে ক্যান্সারের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছিলেন) এবং অন্যান্য টেলিভিশন অনুষ্ঠানগুলি থেকে অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন। তিনি উত্তরাখালী মাউন্টেইনিয়ারিং নেহেরু ইনস্টিটিউট থেকে প্রাথমিক পর্বতারোহণ কোর্সে উত্তীর্ণ হন এবং এভারেস্ট আরোহনের জন্য তাঁর বড় ভাই ওমপ্রকাশ কর্তৃক উৎসাহিত হন। অবশেষে ২০১৩ সালের ২১শে মে তিনি একটি কৃত্রিম পা বা প্রস্থেটিক লেগ দিয়ে মাউন্ট এভারেস্টের চূড়ায় উঠেছিলেন, হয়েছিলেন বিজয়ী। অরুণিমা সিনহার সাফল্য আমাদের শুধু পড়াশোনায় নয়, বরং কঠিনতম পরিস্থিতিতে সবচেয়ে দূরের লক্ষ্যকে ভেদ করবার সাফল্য দেয়।
এবার আসা যাক সুরভী গৌতমের কথায়। এর কথাও অনেকে জানেন হয়তো। মধ্যপ্রদেশের সাতনা জেলার আমদারা গ্রামে একটি ঐতিহ্যগত যুগ্ম পরিবারে সুরভী গৌতম জন্মগ্রহণ করেন। শৈশবকালে যখন তিনি বিদ্যালয়ে পড়তেন তখন তিনি রিমোটিক জ্বরের সাথে লড়াই করেছিলেন এবং মৃত্যুর ভয় সঙ্গে ক্রমাগত যুদ্ধ। সেই গ্রামের হিন্দি বিদ্যালয়ের গরীব মেয়ে থেকে আজ তিনি একটি আইইএস এবং আইএএস যোগ্য নারী হিসাবে সোজা দাঁড়ানোর পথটা সহজ ছিলনা। তিনি সকল মতবিরোধ, কষ্টের বিরুদ্ধে গিয়ে দশম শ্রেণীর বোর্ড পরীক্ষায় গণিত এবং বিজ্ঞান উভয় ক্ষেত্রেই পূর্ণ নম্বর পান এবং তিনি রাষ্ট্রীয় যোগ্যতার তালিকায় ছিলেন।
সুযোগের একটি ফল হিসাবে, সুরভী প্রথম ইউপিএসসির চিন্তা করে যখন তিনি তার ক্লাস টেন-এর বোর্ড পরীক্ষায় পাশ করেন। রাষ্ট্রীয় যোগ্যতার তালিকায় তার পথ তৈরি করার পর, সাক্ষাৎকারে তাকে একটি স্থানীয় সংবাদপত্র থেকে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল যে ভবিষ্যতে কী পরিকল্পনা রয়েছে এবং সে বলেছিল যে তিনি ‘সংগ্রাহক’ হতে চেয়েছিলেন। এখান থেকেই তার যাত্রা শুরু। বহু ওঠা নামা, অনেক লড়াইয়ের পরে তিনি কলেজের পর SAIL, BARC, GATE, ISRO এবং MPPSC পরীক্ষায় একসাথে প্রথমবারের চেষ্টায় উত্তীর্ণ হন এবং ছয় মাস পর তিনি আইইএস পরীক্ষায় দিয়ে প্রথম স্থান এবং তারপর ইউ.পি.এস.সি সিভিল সার্ভিসের পরীক্ষায় প্রথমবারের চেষ্টায় ৫০তম স্থান অধিকার করেন।
একসাথে দেশের মধ্যে লক্ষ লক্ষ মানুষের অনুপ্রেরণা তিনি। তার কণ্ঠস্বরে দৃঢ়সংকল্প রয়েছে যা প্রমাণ করে যে একজন নারী বা পুরুষ আত্মবিশ্বাসের সাথে কীভাবে সাফল্য অর্জন করতে পারে।
অণুপ্রেরণার ভালো উদাহরণ এরকম আরো অনেক দেখা যায় হয়তো। কিন্তু আজও অধিকাংশ মানুষ বিশেষত যুবসমাজ অনুপ্রেরণার আর দৃঢ়তার অভাবে বাকি দুনিয়ার থেকে পিছিয়ে যাচ্ছে এবং নিজেদের জীবনে সহজেই হার মানছে। এর কারণবশত বেকারত্ব, চিন্তা, পরাজয় ও শেষে নিজের উপর বিস্বাসের অভাবে স্ব-ক্ষতি করতে উদ্যত হচ্ছে।
আসলে অনুপ্রেরণা বা যেকোনো রকম প্রেরণা আমাদের ওই বন্দী, আটকে থাকা ভেতরের আত্মাকে বাইরে উন্মুক্ত করতে সাহায্য করে, মুক্ত করে সেই ইচ্ছেগুলোকে যেগুলো কিছুটা হরমোন আর বাকিটা মনের অন্তরালে জড়িয়ে থাকে। কারুর বা কোনোকিছুর দ্বারা উদ্বুদ্ধ হওয়াকেই শুধু প্রেরণা বলে না। যখন নিজের ভেতরের আওয়াজটা বাইরে এসে জোড়ে চেঁচিয়ে বলে যে, “আমি পারব, আমাকে পারতেই হবে, আমাকে বিজয়ী হতেই হবে, আমি ঠিক পারব!”, সেটাকেই বোধহয় সঠিক অর্থে প্রেরণা বলে। গল্পের শুরুর কিছুটা বায়োলজিক্যাল ছিল তবে শেষটা নিতান্তই মানসিক আর ‘বাকিটা?’ – অসমাপ্তই থাক।