আবির সবেমাত্র পেপার টা পড়া শুরু করেছে এমন সময় দরজার ঘণ্টি টা বেজে উঠলো। বাম হাতে ধরা চা এর কাপ এ এক চুমুক মেরে ও পেপার টা ভাঁজ করে টেবিল এ রেখে আবির উঠলো দরজা খুলতে। সম্ভু বাজারে গেছে, তাই ও ছাড়া কেউ নেই ঘরে। ঘণ্টি আরো একবার বেজে উঠলো।
“হ্যাঁ আসছি। এক মিনিট” বলে আবির দরজা খুলল। পাড়ার রতিন পোস্টমাস্টার। ডান হাতে খয়েরি রঙের খাম ও বাম হাতে একটা লম্বা খাতা। দরজা খুলতেই বিনয়ের হাঁসি দিয়ে বলল “বাবু চিঠি আছে আপনার নামে”। আবির ও হাঁসি বিনিময় করে পকেট থেকে চশমা টা বের করে পরে রতিন এর হাত থেকে চিঠি টা নিল।
-“চিঠি তে কোর্টের ছাপ মারা আছে দেখলাম বাবু ” রতিন বলল। কথাটা শুনে আবির চশমার ফাঁক দিয়ে একবার রতিনের দিকে তাকালো। খাম টা ছিঁড়ে ভেতর থেকে চিথিতা বের করে ভাল করে পরতে শুরু করল। রতিন ঠিকই বলেছে। কোর্ট থেকেই সমন এসেছে। আবার তারিখ দিয়েছে কোর্ট। এই ফাঁকে রতিন বলে উঠলো-
-বাবু সাইন টা করে দিন
-হম করছি। একটু দাড়ান।
-বাবু দেরি হয়ে যাচ্ছে। আর জায়েগায়ে যেতে হবে আসলে তাই……
-ওফফ……দিন কোথায় করতে হবে?
রতিন খাতা টা আবির এর দিকে বাড়িয়ে দিল। খাতার ভেতরেই পেন ছিল। আবির সই করে পেন টা পকেটে রাখতে যাছিল , রতিন বাধা দিয়ে বলল “বাবু পেন টা” । আবির জিভ কেটে বলল “ও, ক্ষমা করে দেবেন। রতিন হাল্কা হাঁসি দিয়ে সাইকেল নিয়ে চলে গেলো।
আবির দরজা বন্ধ করে টেবিল এ বসে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে চিঠি টা আবার খুলে পড়তে লাগল। কিছুক্ষণ পড়ে চিঠিটা খামে রেখে, এবং খাম টা টেবিলে রেখে আবির আবার পেপার পড়তে চলে গেল।
“বাবু খাবার তৈরি, চলে আসুন।” সম্ভু বলল।
“হম, রাখ আসছি” আবির উত্তর দিল।
জামার হাতাটা গুটিয়ে আবির এসে চেয়ার টা টেনে বসল। ভাতে ডাল টা মাখাতে মাখাতে সম্ভু কে জিগ্যাসা করল “কিছু হয়েছে নাকি?ওরকম একমনে হয়ে আছিস কেন?”। সম্ভু একটু কাচুমাচু হয়েই জবাব দিল “কই না তো, কিছু না “। আবির এবার সম্ভুর মুখের দিকে তাকাল, এবং ঠোঁটের কনে একটা হালকা হাঁসি দিয়ে বলল “তুই গত ১৫ বছর এখানে কাজ করছিস। এখনও কাথা লুকোস আমার কাছে? তর মুখ দেখেই ধরা পরছে যে কিছু হয়েছে। কি, বলতে চাসনা না বলার সাহস নেই, কোনটা?” । সম্ভু মুখ নিচু করে কথাগুলো শুনছিল। আবির “ছাড়” বলে একটা দীর্ঘ নিশ্বাস ফেলে মুখে ভাত নিতে যাছে, এমন সময় সম্ভু বলে উঠলো ” বাবু আবার তারিখ এসেছে?” । কথাটা শুনে মুখে তলা ভাত টা আবির আবার থালাতে রেখে সম্ভুর দিকে তাকালো। বলল-
– তুই কথা থেকে খবর পেলি?
-টেবিল এ খাম টা পড়ে ছিল। ওটাতেই দেখলুম।
-পড়াশুনা সিখে ফেলেছিস নাকি? সব পড়তে পেরে যাছিস তো।
-বাবু কোর্টের ছাপ বুঝতে পড়াশুনা থোড়ই জানতে হয়! খামে কোর্টের ছাপ মারা ছিল। তা দেখেই বুঝলুম।
-ভালই বুদ্ধি ধরিস তাহলে। হম এসেছে। পরের সপ্তাহে তারিখ।
“দিদি কি জানে?” সম্ভু কাথাটা ঢোক গিলে বলল।
“আমার জানার প্রয়োজন নেই। জেনে যাবেই। খবর তো ওর কাছেও পৌঁছবে। কাথাটা বলে আবির খাবার টা শেষ করে হাত ধুয়ে অফিস এর জন্য তৈরি হয়ে বেরতে লাগল।
” আপনি খবর দিয়ে দিন না দিদি কে” সম্ভু পেছন থেকে বলে উঠলো। আবির একটু দাড়িয়ে বলল “খবর আপনজনকেই দেওয়া হয় সম্ভু। আর ও আমার থেকে দূরে তাখনি ছলে গেছিল যখন ও আমার মেয়ে কে দূরে করেছিল। আর কিছু বলার আছে?”। সম্ভু মুখ নিচু করে রইল। আবির এক্তা দীর্ঘশ্বাস ফেলে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।
“পাগল হয়ে গেছিস নাকি?” বরুন চায়ে এক চুমুক দিয়ে , ভুরু কুচকে বলে উঠলো। বরুন আবির এর ছোটবেলার বন্ধু, পেশায়ে উকিল। তাই আবির এর মামলা টা বরুন ই দেখছে গত ১২ বছর ধরে ” এতটা এগিয়ে আসার পর তুই এই সিধ্বান্ত নিলি? “। আবির মুখ নিচু করে চায়ে এক চুমুক মেরে বলল ” অনেক ভাবলাম বুঝলি। তারপর ঠিক করেছি। দেখলাম এতেই দু পক্ষের ভাল হবে। আর হয়ত আমার মেয়েও আমকে বুঝে উঠতে পারবে। তুই জানিস বরুন………” চা এর কাপ টা টেবিল এ রেখে আবির বলল ” রিনা হয়ত আমার মেয়ে কে আমার ঠিক পরিচয় পর্যন্ত দেইনি। ওর ঘরে গেলে কেমন অচেনা দের মতন তাকিয়ে থাকে। আমি ওর দিকে তাকিয়ে হাসলেও সে হাসেনা। রিনা কে জিগ্যাসা করলাম , ঠিক খুলে বলল না। ভেবে দেখ বরুন , আমি নিজের মেয়ের কাছেই এক অচেনা ব্যাক্তি। তার থেকে ভাল আমি মামলা টাই শেষ করে দি, তার বদল এ আমি আমার মেয়ে কে তো ফেরত পাব। ” বলে আবির বরুন এর মুখের দিকে তাকিয়ে থাকল। বরুন একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল “রিনা কে বলেছিস?”। আবির বলল ” না বিকেলে যাব ওর বাড়ীতে। চল তাহলে উঠছি। দাদার কাছেও যেতে হবে। ” বলে আবির উথে পড়ল। “খাতা তে হিসেব টা লিখে রাখিস, পরের মাসে দেব” আবির বলল মানস কে।
রিনার বাড়ির সামনে দাড়িয়ে আবির মনে সঙ্কোচ রেখে চিন্তা করছে যে বাড়ির কলিং বেল টা বাজাবে কিনা। রিনা দরজা খুলবে কিনা, দরজা খুললে কি বলবে, যদি কিছু জিগ্যাসা করে ফেলে জার উত্তর তার কাছে নেই। মনে একরাশ অভিমান ও আবেগ যেন একসাথে খেলা করছে, কিন্তু তাদের বোঝাপড়া নেই কোনও। কিন্তু তার চখের সামনে তার মেয়ের মুখ টা বারবার ভেসে আসছিল। ছোটবেলার সেই হারিয়ে যাওয়ার দিন গুলো ফুটে উঠছিল। আর হঠাৎ ফুটে উঠলো তার মেয়ের তাকে ছেড়ে ছলে যাওয়ার দৃশ্য। আর নিজেকে সামলাতে পারলনা আবির। মনের জোর নিয়ে বেল টা বাজিয়েই দিল। আরও দুবার বাজাতে হল। তৃতীয় বারে দরজা খুলল। সামনে এক মহিলা। পরনে সবুজ শাড়ি, গায়ের রঙ এতটাই ফরসা যে তাতে রোদের আভা পড়ে শরীরকে সোনালি রঙে আচ্ছিদ করেছে। হাঁটু পর্যন্ত বিস্তৃত ভেজা চুল দিয়ে ঢাকা চোখের একপাশ তার যৌবনতা কে যেন আরও ত্বরান্বিত করে তুলেছে। আবির যেন সেই অদৃশ্য মোহ তেই জড়িয়ে পড়ছিল। সব অবস্থা জেনেও যেন সে নিজেকে আটকাতে পারছিলনা রিনার দিকে এক নির্জীব , নিথর বস্তুর মতন তাকিয়ে থাকতে। সে যেন নিজের জ্ঞান পরিষদ থেকে জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছিল। স্থাবর এর মতন তাকিয়ে আবির রিনার যৌবনতার ঝলক তারিয়ে তারিয়ে উপভোগ করছিল।
“তুমি?” রিনা বলল। আবির যেন হালকা সময়ের জন্য ঢেকে পড়া আচ্ছন্নতা থেকে জেগে উঠলো। এবং সম্মুখিন হল বাস্তব এর রিনার সাথে। যাকে সে খুবই ঘৃণা করে। যাকে সে নিজের ভাবনাতেও মেশাতে চায়না, তাকে খানিক সময়ের জন্য চোখের উন্মাদনা তে কিভাবে জড়িয়ে পড়তে দিল তা ভেবেও আবিরের নিজের প্রতি ঘৃণা হতে লাগল।
আবির রিনার মুখের দিকে না তাকিয়ে উত্তর দিল ” কথা আছে কিছু, ভেতরে কি আসতে পারি?”
রিনা একটু কাচুমাচু ভাবেই এবং একদম নিম্ন স্বরে বলল “এসো”, বলে দরজাটা পুরপুরি খুলে দিল। রিনা আবিরের দিকে পেছন ফেরে ঘরের ভেতর চলতে শুরু করল।
“চা বা কফি কিছু বলব?” রিনা প্রশ্ন করল। আবির একটু গম্ভির ভাবেই জবাব দিল “না, ধন্যবাদ”। রিনা এসে সোফাতে বসল এবং আবির তার মুখমুখি সোফাতে গিয়ে বসল। রিনা বাম পা এর ওপর ডান পা টা তুলে এবং হাট দুত জড়ো করে হাঁটুতে রেখে বলল- “বলো কি কথা ? বৃষ্টি কে নিয়ে?”
আবির এবার রিনার চোখাচোখি হল, বলল – “আজ কোর্টের চিঠি এসেছে। পরের সপ্তাহে শুনানি”। রিনা কথা টা শুনে সোজা হয়ে বসল। “তাই একটা সিদ্বান্ত নিয়ে এসেছি তোমার কাছে”।
” কি সিদ্বান্ত?” রিনা প্রশ্ন করল।
“আগের কারন কে দূর করার সিদ্বান্ত। যে কারনের জন্য পাশাপাশি নেই মুখোমুখি বসে আছি। যে কারনে আমার মেয়ে………” বলে আবির একটা ঢোক গেলল। একটু ভারি ও কাঁপা স্বরে বলল- ” যে কারনে আমার মেয়ে আজ আমার কাছে নেই।”
কথা বলতে বলতে আবিরের গলা ধরে যাচ্ছে। হয়ত কষ্টে, হয়ত আবেগে হয়ত বা ক্রোধে।
আবির আবার বলল “রিনা তুমি পাশে থাকবে এরকম প্রতিশ্রুতি আমাকে দিয়েছিলে। কিন্তু এই প্রথম বিপদেই পিছুটান দিলে? আর এতটাই দূরে চলে গেলে যে আজ ১০ বছর হয়ে দাঁড়িয়েছে। যদি আমরা একসাথে লড়তাম হয়ত এই বিপদ জয় করতে এত সময় লাগতনা।
“আমাকে আমার মেয়ের ভবিষ্যৎ এর কথা চিন্তা করতে হত আবির” সুজাতা বলে উঠ লো।
“বৃষ্টি শুধু তমার একার মেয়ে নয়। বৃষ্টি আমাদের মেয়ে। আর এইটা একটা সাধারন ঘরের ঝামেলে ছিল। যা সব ভাই এর মধেই হয়। আজ সব ভাই এর মধেই দলিল নিয়ে কোর্টের ঝামেলা হয়। তা বলে কি আর আমি আমার মেয়ের ভবিষ্যৎ গড়তে পারতাম না?? আজ আমার মেয়ে আমাকে বাবা বলে চেনেওনা। এই কষ্টটা যেদিন জানতে পারবে সেদিন আসল কষ্ট তা বুঝবে। প্রতি মুহূর্ত নিজেকে হারিয়ে ফেলছিলাম। কিন্তু আর না। তাই …… একটা সিদ্বান্ত নিয়ে এসেছি আমার হাতে।” বলে আবির সোফা থেকে উঠে রিনার দিকে এগিয়ে তার হাতে একটা খাম ধরাল । বলল ” আমি এই দাদার সাথে কথা বলে এলাম। যে ঘর নিয়ে গত ১০ বছর ধরে কোর্টের কাছে যেতে হচ্ছিল সে মামলা দাদা ফেরত নিয়েছে। এবং ঘর আমার নামে। ” কথাটা শুনে সুজাতা সোফা থেকে একটা হাসি নিয়ে উঠে দাঁড়াল। বলল – “সত্যি??”।
আবির বলল – ” হ্যাঁ। আর আমি এই ঘর বৃষ্টির নামে করে দিয়েছি। আর ঠিক করেছি আমি তোমাদের জীবন থেকে সরে যাবো।”
কথাটা শুনে সুজাতা হতবাকের মতন চেয়ে রইলো আবিরের দিকে। মুখের হাসি টা এক মুহূর্তে ম্লান হয়ে গেল।
“কারন আমি আমার জীবনে তোমাদের খুশি ছাড়া কিছুই চাইনি। আর তমার খুশি যদি আমার থেকেও বেশি ওই ঘারের সাথে ওতপ্রত ভাবে জড়িয়ে থাকে তাহলে সেই খুশি দিতেই আমি রাজি আছি। কিন্তু শেই খুশি তোমাকে, আমাকে ভুলিয়ে পেতে হবে। কারন এই ১০ বছরের ব্যাবধান আমি কোনদিন মেটাতে পারবনা। আমি শুধু আমার মেয়েকে ফেরত পেতে চাই এই ছোট খুশি দিয়ে। রিনা তুমি শুধু বৃষ্টি কে আমার পরিচয় টা দিও। আর আমি এই শরিরে বেশিদিন নেই।”
রিনা অবাক হয়ে আবিরের দিকে তাকিয়ে বলল – ” মানে?”
আবির বলল- ” আমার ক্যান্সার ধরা পড়েছে। ২ মাস সময়। তাই এই শেষ কাজ টুকু করে দিলাম। আমার শেষ ইচ্ছে টুকু রেখ। ” বলে আবির খাম টা টেবিলে রেখে বলল- “আমি তমার খুশি এই টেবিলে রেখে গেলাম।” বলে আবির বেরিয়ে ছলে গেল। আর রিনা নিরবাক হয়ে দাঁড়িয়ে থাকল শুধু ওর চোখ থেকে একফোঁটা করে জল পড়তে থাকল।