একটা প্রশ্ন হয়তো অনেকের মনে আসতে পারে যে আজকে এত বিষয় থাকতেও আমি হঠাৎ মডেল অ্যাক্টিভিটি টাস্ক নিয়ে কেন লিখতে বসলাম। আসল কথা হল আমি মনে করি 2020র এই টালমাটাল পরিস্থিতি এবং তার থেকে উদ্ধার পাওয়ার জন্য হাজার হাজার মানুষের নিজেদের অভিযোজিত করার যে প্রক্রিয়া সেটার থেকে বড় কোন টপিক হতেই পারে না, মানুষের সামনে তুলে ধরার জন্য। মডেল অ্যাক্টিভিটি টাস্ক হল সেরকমই একটা দৃষ্টান্ত যা বর্তমান সমাজের প্রাথমিক শিক্ষার বুনিয়াদ রূপে নিজের জায়গা করে নিয়েছে।
বর্তমান সমাজে করোনার থাবা থমকে দিয়েছে শিক্ষা সহ সমাজের সমস্ত গতিবিধি। চাকুরী, চাষবাস, ব্যবসা-বাণিজ্য, রাজনীতি, শিল্প, সংস্কৃতি ও শিক্ষা সমাজের সমস্ত ক্ষেত্রেই করোনা নিজের বিষাক্ত জাল ছড়িয়ে দিয়েছে। আরসব ক্ষেত্রে প্রাপ্ত বয়স্কদের মানসিক জোর, শারীরিক ক্ষমতা এবং অর্থ প্রযুক্তি এই বাধা অনেকাংশে লঘু করলেও শিক্ষার ক্ষেত্রে শিশুদের বিকাশ আজ মহা সংকটের সম্মুখীন। এইরকম এক সংকটপূর্ণ পরিস্থিতিতে সরকারের মডেল অ্যাক্টিভিটি টাস্ক উদ্যোগটি সত্যই প্রশংসার দাবি রাখে।প্রথম শ্রেণী থেকে দশম শ্রেণী অব্দি প্রতিটা শ্রেণীতে মডেল প্রশ্নপত্র প্রদান করা হবে এবং বাড়িতে বসে উত্তর সমাধান করে পুনরায় মূল্যায়নের জন্য বিদ্যালয়ে তা জমা করে আসতে হবে। এটিই হলো এই কর্মসূচির প্রধান বিষয়। বিদ্যালয় অবশ্য অভিজ্ঞ শিক্ষকদের দ্বারা সেই উত্তরপত্র পর্যালোচনা ও মূল্যায়ন করবেন এবং প্রয়োজনে ফোনের মাধ্যমে বা অনলাইনে শিক্ষকরা শিক্ষার্থী বা তার অভিভাবকদের সঙ্গে যোগাযোগ করবেন।
আসলে শিশুদের মন ততটা পরিপূর্ণ হতে পারে না যতটা একটা প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের নিজের ভালো-মন্দ বিচার করার ক্ষমতা থাকে। একজন প্রাপ্তবয়স্ক তার নিজের কাজ নিজের কর্তব্যজ্ঞান সম্পর্কে যতটা সচেতন একজন শিক্ষার্থী কখনোই ততটা সচেতন হতে পারেনা। সুতরাং লকডাউন পরিস্থিতিতেও তারা ধারাবাহিকভাবে নিজের পড়াশোনায় মনোনিবেশ করবে এবং লেখাপড়ার প্রতি যত্নশীল থাকবে এমনটা আশা করা হয়তো বোকামি। সেই কারণেই শিক্ষা পর্ষদের তরফ থেকে ছাত্র-ছাত্রীদের জন্য এইযে মডেল অ্যাক্টিভিটি টাস্ক প্রকল্পটি শুরু করা হয়েছে সেটি নিঃসন্দেহে একজন ছাত্র বা ছাত্রীর কাছে লাভজনক ও আশাপ্রদ।
শুধুমাত্র ছাত্র ছাত্রীদের সঙ্গে লেখাপড়ার সংযোগ বজায় রাখাই নয়। বরণ বিভিন্ন প্রকার কর্মসূচি ও বিভিন্ন রকমের খেলার ছলে শিক্ষা প্রদানের এই যে অভিনব প্রচেষ্টা তা সত্যি প্রশংসনীয়। ঘরে বসেও বিদ্যালয় থেকে প্রতিটা ছাত্রছাত্রীকে কয়েক পৃষ্ঠার মডেল প্রশ্নপত্র সহ বিভিন্ন রকম বুদ্ধিদীপ্তশীল কর্মসূচি প্রদান ও নির্দিষ্ট সময় পরে সেটির মূল্যায়ন সত্যিই ছাত্র-ছাত্রীদের মনে লেখাপড়ার প্রতি এক অন্যরকম অনুপ্রেরণা সৃষ্টি করবে। পাঠ্যবইয়ের অন্তর্ভুক্ত প্রশ্ন ছাড়াও এই মডেল প্রশ্নপত্রে আছে সাধারণ জ্ঞান, পরিবেশ পরিচিতি ,অংকন, রংয়ের কাজ, বিজ্ঞান ও সমাজবিদ্যার বিভিন্ন প্রশ্ন ও কর্মসূচি। যা একজন ছাত্র-ছাত্রীকে শুধুমাত্র বইয়ের পাঠই নয়, বহিরাগত জ্ঞানও প্রদান করে। একইসঙ্গে বিকশিত হয় ছাত্র-ছাত্রীদের বুদ্ধিদীপ্ততার লেভেল ও মানসিক চেতনা।
সুতরাং কোনো ক্ষেত্রেই এই মডেল অ্যাক্টিভিটি টাস্ক উদ্যোগটি একজন ছাত্র ছাত্রীর ক্ষেত্রে অশুভ বা অপ্রয়োজনীয় চাপসৃষ্টিকর একটি ব্যাপার হতে পারে না। তবু একথা বলাইবাহুল্য যে কিছু কিছু ক্ষেত্রে এই প্রকল্পটির কার্যকারিতা ঠিকমতো বাস্তবায়িত হতে পারছেনা। তার কারণ অবশ্যই অভিভাবকদের সচেতনতার অভাব এবং শিক্ষার্থীদের এ বিষয়ে যথেষ্ট জ্ঞানের অভাব। সবার আগে অভিভাবকদের এর গুরুত্ব বোঝাতে হবে। কেন এ প্রকল্পটি শুরু করা হয়েছে, এতে শিক্ষার্থীদের কতটা লাভ হবে, এবং খেলার ছলে কিভাবে এই প্রশ্নগুলি তাদের কাছে সহজবোধ্য করে তোলা হবে এ ব্যাপারে অভিভাবকদের সম্যক জ্ঞান প্রদান করা প্রয়োজন।
পশ্চিমবঙ্গের মত রাজ্যে,যেখানে শিক্ষার হার অনেকটাই পিছিয়ে সেখানে খুব গ্রামেগঞ্জে বা অর্থনৈতিকভাবে দুর্বল শিক্ষার্থীদের পক্ষে এই উদ্যোগটি কতটা গ্রহণযোগ্য হবে তা অবশ্যই ভাববার বিষয়। যাই হোক না কেন, সবশেষে একথা স্বীকার করতেই হয়, গৃহবন্ধি জীবদ্দশায় আর স্মার্টফোনের অনুগ্রহে প্রায় প্রত্যেকটি ছাত্র-ছাত্রীরই বই-খাতার সঙ্গে সম্পর্ক একপ্রকার বিচ্ছিন্নই বলা চলে।সেইরকম এক পরিস্থিতিতে শিক্ষাদপ্তরের এই পদক্ষেপ প্রত্যেকটি শিক্ষার্থী ও তাদের বাবা-মার কাছে ‘তপ্ত গ্রীষ্মের মুখে এক পশলা বৃষ্টির মতই’ কিছুটা আশাপ্রদ ও প্রাণসঞ্চারক সেকথা বলার অপেক্ষা রাখে না।