সবথেকে সুন্দর সকাল কাটে মধ্যবিত্ত দম্পতির যাদের দিন শুরু হয় চিনি দেওয়া সরে মোড়ানো দুধের চায়ে! মধ্যবিত্ত গৃহিণী, গ্যাসে বসানো সস্তার সসপ্যানে দু’চামচ চায়ের পাতা দিয়ে ঘুমন্ত স্বামীর ঘুম ভাঙায়! তারপর একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে চায়ের শান্ত জলে বুদবুদ ওঠার অপেক্ষায়! এরপর স্বামী স্ত্রী ব্যস্ততার অগোচরে দিব্যি বারান্দায় বসে নিজেদের জীবনটাকে সাজিয়ে তোলে! একাকটি দিন তাদের কাছে একটি জীবনের সমতুল্য! এরপর দশটা পাঁচটার অফিস যাওয়া স্বামীর হাতে মাসকাবারির ফর্দ, সবজির নাইনলের থলেটা শোভা পায়! এইমাসে কোনটা বাড়ন্ত, কোনটা একটু আছে, পরে আনলেও চলবে এইসবের হিসেবনিকেশের আদুরে মলাটখানির সাক্ষী থাকে এইসব সকালগুলি!
সবচেয়ে সুন্দর দুপুর কাটায় মধ্যবিত্ত সংসারগুলো! হাতের কাজগুলি শেষ করে গৃহিণী তখন স্নান করে ভেজা মেয়েলি চুলে তুলসীতলায় জল দেয়, ধূপকাঠি জ্বালিয়ে তার ভালোবাসার মানুষগুলোর ভালোথাকার বেচাকেনা করে! তারপর রোদের বিপ্লবে শেষ করে শরৎচন্দ্রের “পরিণীতা” কিংবা “চরিত্রহীন”! তারপর স্টীলের ক্ষয়প্রাপ্ত থালায় আলুবড়ির ঝোলে আর এক টুকরো মাছে সুখ ছোঁয়ায় তৃপ্তির বুকে! অন্যদিকে অফিসের কাজের ব্যস্ততায় মধ্যবিত্তের কর্তা সস্তার টিফিনে রুটি, আলুভাজায় বিলি কেটে প্রতিশ্রুতি দেয় নিজেকে; এইমাসে মাইনে পেলে বউয়ের জন্য নতুন শাড়ি আর সন্তানের জন্য ভালো টিউশন দেবে! এইখানেই ভালবাসার জয় হয়! এক লহমায় ভেঙে যায় মেকি মোহের ক্যালাইডোস্কোপ!
সবথেকে সুন্দর বিকেলের সন্ধান পাওয়া যায় মধ্যবিত্ত বাড়ির অন্দরমহলে! সেখানে মিষ্টি মধুর অপেক্ষা থাকে অফিস ফেরত প্রিয় মানুষটার জন্য! এই বিকেলে নতুন করে চায়ের জল বসে, এই বিকেলে, গেট খোলার শব্দে বাবার আগমনে সন্তানদের প্রানভরা উচ্ছ্বাস থাকে! এই ফুরিয়ে যাওয়া বিকেলগুলোতে বাবার হাত থেকে আলুর চপগুলো ছিনিয়ে নিয়ে মায়ের হেফাজতে চালান করা থাকে! একসাথে খুনসুটি, অসময়ের লাফদড়ি, একথালায় মুড়ি মাখানোর গন্ধ মাখে মধ্যবিত্তের বিকেলবেলাগুলো! সেখানে মানুষগুলো মুগ্ধ হয়ে বাঁচে এসি, ওয়াশিং মেসিন, সোনা কেনার কিংবা দোতালা করার স্বপ্নে! যেখানে চাহিদাগুলো ছোটোই থাকে কিন্তু অফুরন্ত ভালোবাসা, বিশ্বাস, ত্যাগ আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে থাকে মানুষগুলোকে!
এটাও পড়তে পারেন- পরোয়ানাহীন তর্জনী
সবথেকে সুন্দর রাত্রি হয় মধ্যবিত্ত সংসারগুলোতে’ই! সেখানে ধূপের ধূনোতে রাত্রির দুয়ারে আঘাত পড়ে! ছেলেমেয়েগুলো অনিচ্ছাকৃতভাবেই পড়তে বসে, তারপর হঠাৎ লোড্শেডিংএর প্রহরগুলোতেই কাটিয়ে দেয় জীবনের সবথেকে সুন্দর সময়গুলোকে! হ্যারিকেনের আলোয় ফেলে আসে নষ্টালজিয়া! বাড়ির কর্তা তখন এ’মাসে খরচের হিসেব কষে! প্রেসারের ওষুধ, কাশির সিরাপ, প্রিমিয়ামের অতিরিক্তর তালিকাটা অতিক্রান্ত করিয়ে দিয়েছে হিসেবের অন্তিম স্টেশন, তাই কপালে বৃদ্ধি পায় চিন্তার বলিরেখা! এইসব রাতেই গৃহিণী তার স্বামীর থমথমে মুখ দেখেই বাড়িয়ে দিয়েছে গলার পাতলা একরত্তি চেনটা! জীবন তখন চোখের ভাষায় না বলা কথার বিনিময় দেখে দূরে কোথাও হাসতে থাকে! কে বলেছে আজকাল ভালোবাসা নেই, সবকিছুই নাকি মেকি, মিথ্যে! কোনটা মিথ্যে? এইসব ঘুমভাঙা সজীব চোখের নির্ভরতাগুলো নাকি হঠাৎ পাওয়া কান্নাগুলো নাকি নির্ভরতাগুলো!! সবেতেই ভালোবাসা লুকিয়ে আছে যে! হয়তো ভালোবাসা মানে এমনই কিছু বাঁচার আশা, এমনই কিছু বুনোট স্বপ্নের হাতে প্রিয় মানুষের কাঁধে মাথা দেওয়া! রূপকথারা এইভাবেই গল্প হয়ে যায় মধ্যবিত্তের চিলেকোঠায়! এরপর ঘুম নামে অলসতায়, ঘুম নামে তপ্ত বুকের ভেতর!
তারপর রাত্রি কেটে ভোর হয়! দূরে কোথাও ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা শহরটাকে জাগিয়ে তুলতে দারোয়ান হুইসেল ফুঁকে বলে ওঠে- ” জাগতে রাহো…”!! মধ্যবিত্তরা শোনে-” বাঁচতে রাহো…!!” তারা জেগে ওঠে, শুরু করে তাদের রোচনামচা, আরেকটি সবচেয়ে সুন্দর দিনরাত্রি কাটানোর জন্য কারণ মধ্যবিত্ত রোজ মরে আর রোজ নতুন করে বাঁচে!