*লোভ*
তখন বেলা ১১টা হবে, ছুটতে ছুটতে ক্লাবে এসেই একটা লম্বা নিঃশ্বাস ফেলে বিক্রম আমাকে বলল,
– ভাই জানিস ৩৯ নম্বর ম্যাচটা গুজরাট হারবে। ম্যাচটাই ফিক্সিং হয়েছে।
– মানে? কি বলছিস এসব তুই!
ক্যারাম থেকে চোখটা সরিয়ে একটু অবাক হয়েই বললাম।
– আরে ভাই আই.পি.এল এর কথা বলছি। জাহাঙ্গীর দা আমাকে বলল গুজরাটের কয়েকজন প্লেয়ার টাকা খেয়েছে, তাই পাঞ্জাব জিতছেই।
– ধুর! পাগলের মতো কথা বলিস না। এখন কোন প্লেয়ারের এত সাহস হবে না। ধরা পড়লে কি হতে পারে ওদের বুঝতে পারছিস।
– আরে গাধা এগুলো হয়েই থাকে, আগে তো প্রত্যেক ম্যাচে হতো।এখন একটু কমেছে কিন্তু বন্ধ হয় নি। আমাকে জাহাঙ্গীর দা বলল ৫০ লাখ লাগিয়ে দিতে, তারপর জিতলেই একদম এক কোটির মালিক।
– ভাই প্লিজ এসবের মধ্যে থাকিস না তুই। কি থেকে কি হয়ে যাবে… ধরা পড়লে কিন্তু সবাই ফাসবি।
– ধুর! আমি কি প্লেয়ার দের টাকা দিচ্ছি নাকি। আমি তো শুধু বেটিং করছি তাই ধরা পড়লেও আমার চাপ হবে না বুঝলি। জাহাঙ্গীর দা খবর পেয়েছে তাই আমাকে জানিয়েছে। বুকি মানুষ জাহাঙ্গীর দা জানিসই তো, ফিক্সিং গুলো তো ওরাই করে।
– তাহলে দেখ যা ভালো বুঝবি তুই। আমি বাড়ি গেলাম এখন, পরে কথা হবে এই নিয়ে।
– আচ্ছা! তোকে রাত্রে ফোন করবো বুঝলি, ক্লাবে এলাম যখন একটু ক্যারাম পিটিয়ে নিই।
(২) আমি অনীক,অনীক চৌধুরী। বিক্রম আর আমি সেই ক্লাস ওয়ান থেকে একসাথে পড়ছি।প্রথম থেকেই বিক্রম আমার বেস্ট ফেন্ড। পড়াশোনায় আমরা মোটামুটি ছিলাম। কোনদিন খুব ভালো রেসাল্ট করি নি। মাধ্যমিকে দুজনেই ফাস্ট ডিভিশন পেয়েছিলাম। তবে মাধ্যমিকের পর থেকেই বিক্রম এর মধ্যে চরম পরিবর্তন আসে। বিক্রম একটু বেশিই টাকা চিনে ফেলে। বাড়ি থেকে তেমন টাকা পেতো না বলে নিজেই টাকা রোজগারের রাস্তা খুঁজতে শুরু করে। আমাদের যখন ক্লাস ইলেভেন তখন বিক্রমকে একটা টিউশনি খুঁজে দিই আমি। তবে ধীরে ধীরে খারাপ সঙ্গ বিক্রমকে টানতে থাকে। টাকার নেশায় বিক্রম জুয়া খেলতে শুরু করে। অনেক বার বারণও করেছিলাম ওকে, কিন্তু শোনে নি। প্রত্যেক বার আমাকে বলেছে ” আমি বড়লোক হতে চাই,অনেক বড়লোক! সেটা যেভাবেই হোক।”
ওকে বোঝাতে পারি নি এভাবে কেউ বড়লোক হয় না। বিক্রমের বাবা পোস্ট অফিসে চাকরি করতেন এখন উনি রিটায়ার্ড করেছেন। বাড়ির এক ছেলে বিক্রম কে নিয়ে কাকু কাকিমার অনেক স্বপ্ন। কিন্তু ছেলে সেটা বুঝলে তো। বিক্রমের স্বপ্ন গুলো যে সবই বড়লোকি।
আগের বছর আমরা উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করে দুজনেই একই কলেজে ভর্তি হলাম। কলেজে উঠে বিক্রমের নতুন নেশা হল ক্রিকেট ম্যাচে বেটিং করা। বেটিং এর মাত্রা টা বেড়ে যেত আই.পি.এল এর সময়। বেশির ভাগ ম্যাচই বিক্রম জিততো। তাই হয়তো লোভ টা দিনের দিন ওর বাড়ছিল। বিক্রম এর বড়লোক হওয়ার স্বপ্নও পূরণ হচ্ছিল। হাতে সোনার বালা, পালসার বাইক আর দামী মোবাইল দেখে সেটা আন্দাজ করাই যেত।
কিছুদিন আগে আমার মায়ের খুব অসুখ করেছিল। আত্মীয় স্বজন কেউ চিকিৎসার জন্য দু পয়সা দিয়ে সাহায্য করে নি আমাকে। তখন বিক্রম-ই আমাকে হাজার খানেক টাকা দেয়। হয়তো মাকে বাঁচাতে পেরেছিলাম ওর জন্যই । এইজন্য ওকে আর আমি বেটিং নিয়ে কিছু বলতে পারি না জোর গলায়।
(৩) ঘড়িতে রাত ১০টা, মোবাইল টা নিয়ে একটু ফেসবুক করছিলাম। হঠাৎ ফোনটা বেজে উঠল। দেখলাম স্ক্রিনের উপর বিক্রমের নাম। ফোন তুলতেই,
– হ্যালো, ভাই ৫০ লাখ কি করে জোগাড় করবো বল না! আগে তো টাকা-টা জমা দিতে হবে আমাকে বুকির হাতে!
– এটা একটা অনেক বড় ক্রাইম কিন্তু বিক্রম, তুই কি কিছুই বুঝিস না? বড়লোক হওয়ার নেশা কি তোকে অন্ধ করে দিয়েছে?
– আরে গাধা, ভাবতে পারছিস এক কোটি হাতে আসবে আমার।এত গুলো টাকার জন্য রিস্ক নেবো না একটু?
– তুই ৫০ লাখ পাবি কোথায়, কে দেবে তোকে বেটিং খেলার জন্য অত টাকা?
– ভাবছি বাড়ির আলমারি থেকে মায়ের সব গয়না বের করে জাহাঙ্গীর দার কাছে বন্দক রাখবো, আর বাবার কিছু জমানো টাকাও দেবো। তারপর ম্যাচ শেষে একদম এক কোটি নিয়ে বাড়ি ফিরবো।
– ছিঃ! কিছু বলার নেই তোকে, আমি রাখলাম ফোন। তোর যা ঠিক মনে হয় কর।
কথাটা শেষ করেই ভীষণ বিরক্তির সাথে ফোনটা কেটে দিলাম আমি।
এই ঘটনার পর টানা দু সপ্তাহ আমি বিক্রমের সাথে একটাও কথা বলি নি। বিক্রম একদিন হঠাৎ আমার বাড়ি এসে বলল,
” আর কতদিন রেগে থাকবি ভাই, প্লিজ বোঝ একটু… কোটিপতি হয়ে যাবো। পরশু কিন্তু খেলাটা, বুঝলি? ক্লাবে চলে আসিস একসাথে খেলা দেখবো। সেদিন ক্লাবে পিকনিক হবে বিরিয়ানির।
ওর কথার একটাও উত্তর দিলাম না, শুধু মাথা নাড়িয়ে বোঝালাম যাবো।
সত্যি বলতে আমার নিজের খুব খারাপ লাগছিল। বিক্রম এমনিতে খুব ভালো ছেলে। কিন্তু ওই যে কথাই আছে “সঙ্গ দোষে লোহা ভাসে।”
৪) এরপর এলো সেই দিন, মানে আই.পি.এল এর ৩৯ নম্বর ম্যাচ। গুজরাট মুখোমুখি পাঞ্জাবের। আজকের ম্যাচটা যে জিতবে সেই প্লে-অফ এ জায়গা করে নেবে। ক্লাবে পা দিতেই দেখলাম একটা উৎসব এর আমেজ। খেলা শুরু হল, পাঞ্জাবে টসে জিতে বোলিং নিয়েছে। প্রথম ওভারেই গুজরাটের দুটো উইকেট পড়ে গেল। জাহাঙ্গীর দার ফোন ঢুকল বিক্রমের ফোনে। বিক্রম আমাদের জানালো, কুড়ি ওভাবে ১৪৬ মতো টার্গেট দেবে গুজরাট। আর সেই রানটা সহজেই তুলে দেবে পাঞ্জাব। সত্যি বলতে একটু হাসিই পাচ্ছিল নিজের। এতদিন শুধু শুনেই এসেছিলাম এসব ফিক্সিং এর কথা। পাচ ওভার শেষে গুজরাটের রান ২৫/২, স্কোর দেখে বোঝাই যাচ্ছিল গুজরাট লজ্জাজনক ভাবেই হারবে আজ। এদিকে বিক্রমের মুখে চোখে আনন্দও দেখার মতো। শেষের দিকে একটা প্লেয়ার কয়েকটা ছক্কা হাকিয়ে ১৪৭ পর্যন্ত নিয়ে গেল রান টা। পঞ্জাবের টার্গেট ১৪৮ কুড়ি ওভারে। বুঝলাম খুব সহজে পাঞ্জাব এই রান তুলে দেবে এবং জিতবে। বাজির ফোয়ারা তখন আমাদের ক্লাবে।
(৫) পাঞ্জাব ব্যাটিং এ নামা মাত্রই আক্রমণ করতে দেখলাম বোলার দের উপর। পাঞ্জাবের বাউন্ডারি হলেই চিৎকার করছিল বিক্রম। ৯ ওভার শেষে পাঞ্জাবের রান দাঁড়ালো ৭৭/১, মানে জিততে গেলে ১১ ওভারে ৭১ রান লাগে। এখান থেকে জেতাটা শুধুই সময়ের অপেক্ষা, কিন্তু হঠাৎ করেই ১১ নম্বর ওভারে গুজরাটের একটি বোলার হ্যাটট্রিক করে দিল। পাঞ্জাব এই প্রথম ম্যাচে একটু চাপে এল। বিক্রম দেখলাম একটু নরম গলায় বলল, “সে উইকেট পড়ুক জিতবে তো পাঞ্জাব-ই”। শেষে খেলাটা এমন জায়গায় চলে এল যখন পাঞ্জাবকে জিততে গেলে দুই ওভারে ২১ রান দরকার। গুজরাটের একটি বোলার ওয়াইড দিয়ে শুরু করল ওভারটা, মানে দুই ওভারে ২০ দরকার। পরের বল গুলোই বোলারটা মাত্র ৫ রান দিল সঙ্গে একটা উইকেট। বিক্রমের চোখে মুখে চিন্তার ছাপ দেখলাম। শেষ ওভারে জিততে গেলে ১৫ রান দরকার। কিন্তু হঠাৎ করে একটা নতুন বোলারের আগমন শেষ ওভারে। যার মাথায় কালো হেয়ার ব্যান্ড লাগানো। অনেক গুলো প্রশ্ন এল মাথায়। এ কি তাহলে পাঞ্জাবকে জেতানোর জন্য বোলিং এ এলো?। প্রথম বল এই ছক্কা হাকিয়ে দিল পাঞ্জাব এর একটি ব্যাটসম্যান। তারপরের বলটাই এক রান। জিততে গেলে চার বলে আট দরকার। তারপরের বলেই স্ট্যাম্প উড়িয়ে দিল ব্যাটসম্যান এর। তিন বলে আট দরকার, বিক্রমের চোখ কান লাল হয়ে গেছে চাপে। খেলার শেষে বলটাই দরকার পাচ রান জিততে গেলে। শেষ বলটাই এক রান, জিতে গেল গুজরাট চার রানে।
(৬) বিক্রমের সঙ্গে আমরাও নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছিলাম না। বিক্রমকে বললাম জাহাঙ্গীর দা কে ফোন কর এক্ষুণি, কলটা লাগালো না ফোন সুইচ অফ। সঙ্গে সঙ্গে জাহাঙ্গীর দার বাড়ি গেলাম আমরা, বাড়িতে দেখলাম তালা ঝুলছে। বিক্রম মাথাই হাত দিয়ে বসে পড়ল ওখানেই। মায়ের গয়না,বাবার জমানো টাকা সব জাহাঙ্গীর এর কাছেই জমা। সত্যি বলতে কোন ভাষা ছিল না আমার বিক্রমকে সান্ত্বনা দেওয়ার মতো। শুধু ওকে বাড়ি রেখে আসার সময় বললাম, “গয়না তুই ফেরত পাবিই, দরকার হলে থানা পুলিশ করবো। ওই জাহাঙ্গীরকে ছাড়বো না”। আমাদের এতো বছরের বন্ধুত্বে প্রথমবার কাঁদতে দেখলাম আমি বিক্রমকে। বিক্রম আমার কথা সব শুনলো কিন্তু কিছুই বলতে পারলো না। হয়তো গলা দিয়ে কথা বেরোচ্ছিল না। বাড়ি ঢোকার সময় একবার মাথা ঘুরিয়ে আমার দিকে তাকালো শুধু।
পরের দিন সকালে যখন আমার ঘুম ভাঙলো খবর পেলাম বিক্রম আর নেই। রাতেই সুইসাইড করেছে। হেরে গেছে বিক্রম নিজের কাছেই। ওর বাড়ি গিয়ে দেখলাম হাত পা ছড়িয়ে বডিটা মেঝেই পড়ে আছে। সুইসাইড নোটে লেখা “আমাকে ক্ষমা করে দিও মা, বাবা!”
আমাদের বিক্রম হেরে গেছে।