প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাই যে শিক্ষাজগতের শেষ কথা নয়, তা আরেকবার প্রমাণ করলেন ভারতের শকুন্তলা দেবী, দ্য হিউম্যান কম্পিউটার। না, তিনি কোনোদিন কোনো স্কুল বা কলেজে পড়েননি তা সত্ত্বেও শুধুমাত্র নিজের প্রতিভা দিয়ে কাঁপালেন বিশ্ব। তিনি তাঁর সময়ের সবচেয়ে উন্নত কম্পিউটারের থেকে তাড়াতাড়ি গণনা করতেন, তাও একদম নির্ভুলভাবে। বরং কম্পিউটারের ভুল হয়েছে তো তাঁর ভুল নৈব নৈব চ। ভারতীয় গণিতশাস্ত্রের ইতিহাসে আর্যভট্ট ও রামানুজমের সাথে তাঁর নামও একই সারিতে, একই মর্যাদায় উচ্চারিত হয়।
শকুন্তলা দেবী জন্মগ্রহণ করেন ১৯২৯ সালের ৪ই নভেম্বর, ভারতের কর্ণাটক রাজ্যের ব্যাঙ্গালোরে, এক কন্নড় হিন্দু ব্রাহ্মণ পরিবারে। তাঁর বাবা পুরোহিত হয়ে পারিবারিক জীবিকা নির্বাহ না করে বেছে নেন সার্কাসকর্মীর জীবন। তাই যাযাবরের মত এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় ছুটে বেড়াতে হয়েছে তাদের, স্কুলে ভর্তি হওয়ার সুযোগ মেলেনি সেজন্য।
শকুন্তলা দেবীর বাবা তার তিন বছরের কন্যাটিকে তাসের খেলা শেখানোর জন্য তাঁকে নিয়ে তাস খেলছিলেন একদিন। ওইটুকু শিশুর কাছে বারবার হেরে গেলেন তিনি। অবাক হলেন ওইটুকু শিশুর সংখ্যা মনে রাখার ক্ষমতা দেখে। তাঁর বাবা সার্কাসের কাজ ছেড়ে দিয়ে মেয়েকে নিয়ে রাস্তায় রাস্তায় রোড শো করে বেড়াতে লাগলেন, তার মেয়ের অসাধারণ গণনা করার ক্ষমতা দেখিয়ে।
শকুন্তলা দেবী মাত্র ছয় বছর বয়সে মাইশোর বিশ্ববিদ্যালয়ে তাঁর অ্যারিথমেটিক এবিলিটি প্রদর্শন করেন। সবটাই তিনি করেছিলেন কোনো প্রথাগত শিক্ষা ছাড়া। ১৯৪৪ সালে তিনি লণ্ডন যান।
ইউরোপে একবার বি.বি.সি. এক ইন্টারভিউতে শকুন্তলা দেবীকে আমন্ত্রণ জানান। তাঁকে রীতিমতো কঠিন একটি ক্যালকুলেশন দেওয়া হয়। শকুন্তলা দেবী নিমেষে উত্তর বের করে দেন। কিন্তু সেখানে থাকা গণিতজ্ঞদের বের করা উত্তরের সাথে তাঁর উত্তর মেলে না। বড় বড় গণিতজ্ঞ দিনের পর দিন মাথার ঘাম পায়ে ফেলে যে উত্তর বের করেছেন, সেই উত্তর ভুল, তাই আবার হয় নাকি! সবাই ভাবল ভুলটা শকুন্তলা দেবীর। কিন্তু, পরে দেখা গেল ভুলটা তাদেরই হয়েছে। এরপর থেকে সবাই তাঁকে ‘হিউম্যান ক্যালকুলেটর’ বলে ডাকতে শুরু করল।
শকুন্তলা দেবী পৃথিবীর অনেক দেশ ভ্রমণ করে তার এই বিশেষ ক্ষমতা প্রদর্শন করেন। ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের এডুকেশনাল সাইকোলজির অধ্যাপক তাঁর এই মানসিক সক্ষমতা পর্যবেক্ষণ করেন। কীভাবে শকুন্তলা দেবী বড় বড় সংখ্যা যেমন, ৬১৬২৯৮৭৫ এর ঘনমূল বা, ১৭০৮৫৯৩৭৫ এর সপ্তম মূল ইত্যাদি নিমেষে হিসেব করে উত্তর বের করে ফেলেন। তাও আবার একদম সঠিক উত্তর। তাও আবার এত তাড়াতাড়ি যে ততক্ষণে জেনসন সাহেবের প্রবলেম গুলো নোটবুকেই তোলা হয়নি। জেনসন তার সমস্ত পর্যবেক্ষণ অ্যাকাডেমিক জার্নাল ইন্টেলিজেন্সে প্রকাশ করলেন ১৯৯০ সালে।
১৯৭৭ সালে সাউদার্থ মেথোডিস্ট বিশ্ববিদ্যালয়ে ২০১ ডিজিটের একটি সংখ্যার ২৩ তম মূল সমাধান করেন মাত্র ৫০ সেকেন্ড। তাঁর উত্তর ছিল ৫৪৬৩৭২৮৯১। উত্তরটি সঠিক কিনা বিবেচিত হয় ইউ এস ব্যুরো অফ স্ট্যান্ডার্ডস এর ইউনিভ্যাক ১১০১ কম্পিউটার দ্বারা। বলাই বাহুল্য, যে কম্পিউটারের এই সমস্যার সমাধান বের করতে তার চেয়ে বেশি সময় লেগেছিল। ১৯৮০ সালের ১৮ ই জুন, তিনি দুটি ১৩ ডিজিটের সংখ্যার সঠিক গুণফল বের করেন মাত্র ২৮ সেকেন্ডে। এই ইভেন্টটি ১৯৮২ সালে গিনেস বুক অফ রেকর্ডসে ওঠে। এরপর থেকেই তিনি ‘দ্য হিউম্যান কম্পিউটার’ নামে পরিচিত হন।
এটাও পড়তে পারেন শোকের কৃষ্ণগহ্বর
শকুন্তলা দেবী এইসব জটিল ও বৃহৎ সমস্যা সমাধানের পদ্ধতি নিয়ে আলোচনা করেছেন, ‘দ্য জয় অফ নাম্বারস’ বইটিতে।
এবার আসা যাক তাঁর ব্যক্তিগত জীবন সম্পর্কে ১৯৬০ সালে ভারতে ফিরে তিনি বিবাহ-বন্ধনে আবদ্ধ হন কলকাতার পরিতোষ ব্যানার্জির সাথে। যিনি ছিলেন একজন আই. এ. এস. অফিসার। তাঁঁদের একটি কন্যাসন্তান আছে। তাঁদের ডিভোর্স হয়ে যায় ১৯৭৯ সালে। শকুন্তলা দেবী নির্বাচনেও প্রার্থী হিসেবে অংশগ্রহণ করেন, তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর বিরুদ্ধে। মোট প্রাপ্ত ভোটের ১.৪৭ শতাংশ ভোট পান তিনি।
১৯৭৭ সালে তিনি সমকামীদের নিয়ে একটি বই লেখেন ‘দ্য ওয়ার্ল্ড অফ হোমোসেক্সুয়ালস’। এছাড়াও ‘অ্যাস্ট্রোলজি ফর ইউ’, ‘বুক অফ নাম্বারস’, ‘ইন দ্য ওয়ান্ডারল্যান্ড অফ নাম্বারস’, ‘পারফেক্ট মার্ডার’ ইত্যাদি বই তিনি লিখে গেছেন।
২০১৩ সালে শ্বাসকষ্ট ও হার্টের সমস্যাজনিত কারণে তাঁর মৃত্যু হয় ৮৩ বছর বয়সে। সম্প্রতি তাঁকে নিয়ে একটি বায়োপিক তৈরি হয়েছে। যেখানে তাঁর ভূমিকায় অভিনয় করেছেন বিদ্যা বালান ও তাঁর স্বামীর চরিত্রে রয়েছেন যীশু সেনগুপ্ত। তাঁর বর্ণময় জীবনের ঘটনাগুলি ফুটিয়ে তোলা হয়েছে এই বায়োপিকে।