কলকাতায় কলেজ জীবন শেষ করে আমি দিল্লি চলে যাই, টেলিফোন ডিপার্টমেন্টে কর্মরত। কয়েক মাস পর কর্ম সূত্রে নিখিল চলে যায় উত্তর প্রদেশ। কলেজেই আমাদের বন্ধুত্বের সূত্রপাত। বিগত তিন বছর আমাদের দেখা হয় না। নিজের জীবনে যে যার মতো করে ব্যস্ত; মাঝে মাঝে ফোন বা সোস্যাল মিডিয়া চ্যাটিং।
একদিন ফোনে কথায় কথায় নিখিল বলে,
“অখিলেশ, দিল্লি ঘুরে দেখার খুব ইচ্ছা, ইন্ডিয়া গেট, লাল কেল্লা, এই সব না দেখলে জীবন বৃথা।”
উত্তরে বলি, “তুই তো নিজেই ব্যস্ত; আমি তো আগেই বলেছি দিল্লি আসলে আমি নিজেই ঘুরিয়ে দেখাব, তাহলে চলে আয় এই উইকেন্ডে। কলকাতায় রান্নাটা বেশ করতিস তুই, তবে তিন বছর একা থাকতে থাকতে আমার রান্নার হাতটা খাসা হয়েছে। তোর পছন্দের মটন বিরিয়ানি আর চিকেন চাপ বানিয়ে খাওয়াবো। “
“তাই নাকি তাহলে তোর হাতে বানানো খাবার খেতেই যেতে হবে। এই শুক্রবার ফাইনাল। “
শুক্রবার সকাল থেকেই একঘেয়ে ছিপছিপে বৃষ্টি শুরু হয়েছে, আকাশ মেঘাচ্ছন্ন। প্রিয় বন্ধুর সাথে তিন বছর পর দেখা হওয়ার আনন্দ ছিল সাথে এক অদ্ভুত বিষণ্ণতা গ্রাস করছিল আমাকে।
কথামত একটা বেজে দশ মিনিট এর ট্রেনে রওনা হয়ে ছিল, রাত সাড়ে আটটায় দিল্লি পৌঁছানোর কথা নিখিলের। আমার সাথে নিখিলের শেষ বারের মতো কথা হয়েছিল বিকেল পাঁচটা নাগাদ। তখনই নিখিল জানায় তার ট্রেন আধ ঘন্টা লেট আছে। তারপর থেকেই যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় নিখিলের সাথে। রান্না শেষ করে ডাইনিং টেবিল সাজিয়ে বোকা বাক্সের সামনে বসলাম। সন্ধ্যে থেকে ঝোড়ো হাওয়ার গতিবেগ বেড়েছে সাথে ইলশে গুড়ি হয়ে চলেছে।
ঘড়িতে তখন নয়টা। অপেক্ষার সাথে সাথে উদ্বেগ আর দুশ্চিন্তা বাড়ছিল আমার। আচমকা লোডশেডিং হয়ে যায়। একটা বাতি জ্বালিয়ে বসতে যাব এমন সময় দরজায় কড়া নাড়ার শব্দ। দরজা খুলতেই চিন্তা আর অপেক্ষার অবসান ঘটল আমার।
“এতো দেরী করলি নিখিল, ফোনটাও নট রিচেবেল ছিল, কী দুশ্চিন্তা যে হচ্ছিল, লোডশেডিং তুই আসার মিনিট পাঁচেক আগেই হল। “
ফ্যাস ফ্যাসে গলায় নিখিল উত্তরে বলে, “আমার খুব খিদে পেয়েছে অখি। “
আমার একটু অদ্ভুত ঠেকলো,”গলা ধরেছে তোর, নিশ্চয়ই বৃষ্টিতে ভিজে? তুই ফ্রেস হয়ে নে, আমি সার্ভ করছি। “
একটা দমকা হাওয়ায় টেবিলের বাতিটা নিভে যায়। ঘরটা তখন অন্ধকারাচ্ছন্ন। বিদ্যুৎ- এর ঝলকানি মাঝে মধ্যে অন্ধকার ভেদ করছে। আলো আঁধারে নিখিলকে স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছিনা। নিখিলের উদ্দেশ্যে বললাম, “ফোনটা খুঁজে পাচ্ছিনা নিখিল, বাতিটাও নিভে গেল, তোর ফোনের টর্চ জ্বালা। “
“ফোন আর লাগবে না , অন্ধকারে আমার বেশ ভালো লাগছে অখি।”, ক্ষীণ গলায় উত্তর দেয় নিখিল।
শরীরটা ক্রমশ ভারী হয়ে যাচ্ছিল আমার। কিন্তু সেদিকে ভ্রুক্ষেপ না করে অন্ধকারে ডিনার করতে করতে জমিয়ে আড্ডা দিচ্ছিলাম দুই বন্ধু। হঠাৎ নিখিলের হাতের সাথে ছোঁয়া লাগতেই শিউরে উঠে বললাম, ” নিখিল তোর হাতটা বরফের ন্যায় হিম শীতল, জ্বর আসছে তোর? “
“না আমি ঠিক আছি অখি। “
কথোপকথনের মাঝে অদ্ভুত ভাবে নিখিল হেসে বললো, “অনেক দিন পর দেখলাম তোকে। আমাকে নিজের হাতে তৈরি খাবার খাওয়ানোর ইচ্ছে তোর পূরণ হয়ে গেল অখি, আমারও সাধ ছিল তোর হাতে তৈরি খাবার… “
হঠাৎ আলোগুলো জ্বলে উঠে, ঘাড় তুলে দেখতেই চমকে যাই আমি। সামনের চেয়ার ফাঁকা, খাবারের প্লেটে মাংসের চিবানো হাঁড় ছাড়া কিছুই অবশিষ্ট নেই, তখন বেশ কিছুটা খাবার বাকি ছিল আমার। এত তাড়াতাড়ি নিখিল অন্ধকারে খাবার শেষ করে গেল কোথায়? দরজাটা ভিতর দিয়ে বন্ধ। হাঁক ডাক করলাম, “নিখিল… নিখিল… “
হঠাৎ চোখটা টিভির নিউজ চ্যানেলের শিরোনামে পড়লো, “১:১০ -এর উত্তর প্রদেশ থেকে দিল্লিগামী ট্রেন লাইন চ্যুত হয়ে দূর্ঘটনা…”
কপালে বিন্দু বিন্দু ঘামের ফোঁটা, চোখের জল গাল বেয়ে গড়িয়ে পড়ছে, শরীরের সব ভার এক লহমায় হালকা হয়ে গেল। মাথায় শুধু নিখিলের অসমাপ্ত কথাগুলো ঘুরপাক খাচ্ছে। কিছু হিসাবে মেলাতে পারছি না। থম মেরে সোফায় বসে পড়লাম- “তাহলে কী নিখিল…”
সমাপ্ত