১।
জানালার ধারে মাথা ঠেকিয়ে বসে আছে মিতা। পোশাক আলুথালু, চুল অবিন্যস্ত; মুখে একটা গাঢ় কষ্ট ছাপ ফেলেছে যেন। বাইরে অঝোর ধারায় একটানা বৃষ্টি পড়ে যাচ্ছে, বজ্রপাতের আওয়াজে কানে তালা লাগার পরিস্থিতি প্রায়―
ও ডুকরে কেঁদে উঠলো আরেকটা তীব্র বজ্রপাতে। আজ দু’মাস হল তার স্বামী ফেরেনি, খোঁজ নেই তার কোনও। বিয়ের এক মাস হতে না হতেই কাজের খোঁজে ভিনরাজ্যে গিয়েছিল সে, বলেছিল কাজ পেলে নতুন শাড়ি কিনে আনবে। মিতা শাড়ি বদলায়নি আজ দু’মাস হল।
২।
ছবিটা আজ পরিষ্কার করা হয়নি অপলার। সময় পায়নি যে! স্নান সেরে বেরোতেই দেখলো, যে মেঘটা স্নানের ঘর থেকে দেখে দূরে মনে হয়েছিল, এখন সেটা প্রকান্ড কালো হয়ে ছেয়ে ফেলেছে আকাশ। দেখেই যে কি হলো ওর! একছুটে ছাদে চলে গেল। প্রথমে দু-এক ফোঁটা, তারপর মুষলধারে বৃষ্টি এসে ভিজিয়ে দিলো সর্বাঙ্গ। আহ! আজ যেন অপলা অনেকদিনের পর এতটা তৃপ্তি পেল। বিয়ের বছরখানেক পর নির্বাণ যেদিন প্রথম এসেছিল, তেরঙা কাপড়ে মুড়ে, সেদিনের পর থেকে আর ও বৃষ্টি ভেজেনি কখনও। আঁজলা ভরে জল নিলো অপলা, আজ নির্বাণের ছবি এই জল দিয়েই মুছবে।
৩।
আজ ইন্দিরা দেবীর রুটিনে হেরফের হয়ে গেল কিছুটা, সৌজন্যে আবহাওয়া। সকালের প্রথম আলো চোখে পড়তেই যাঁর ঘুম ভাঙে, তিনি আজ সকাল হওয়াটা টেরই পাননি আকাশজুড়ে কালো মেঘের দাদাগিরিতে। চব্বিশ বছরে তাঁর ঘুম থেকে দেরি করে ওঠার ঘটনা এই প্রথম। বিয়ে হয়ে আসার পর তাঁর শাশুড়ি-মা তাঁকে যেমন করে গড়েছিলেন, ইন্দিরা দেবী আজও ঠিক তেমনই আছেন। আজ সকাল থেকেই ওনার মন উচাটন, প্রতি বর্ষা এই উচাটন ফিরিয়ে আনে তাঁর জীবনে। অখিল অ্যাক্সিডেন্টে গত হয়েছেন আজ সতেরো বছর, নিঃসন্তান ইন্দিরা দেবী একা থাকতেই অভ্যস্ত। তবু, বিয়ের পরে বহু বর্ষার স্মৃতি যখন ভিড় করে আসে, চোখটা আপনা থেকেই ভিজে আসে। বৃষ্টিতে ভেজা হয়নি কত কাল, কত বর্ষা শুকনো কেটেছে; আজ আরও একটা বৃষ্টিদিন কাটবে, এবারও ভেজা হবে না ইন্দিরা দেবীর।
এমন কত মিতা, কত অপলা, কত ইন্দিরা দেবী ছড়িয়ে আছে গোটা শহরের বুকে। তাদের হিসাব কেউ রাখে না, তাদের খবর কেউ নেয় না। বৃষ্টি আমাদের জন্য প্রেম, ভালোবাসা, গান, আবেগ― এত কিছু হতেই পারে; কিন্তু তাদের জন্য বর্ষা ভীষণ কষ্ট আনে। এই যে একটা অব্যক্ত যন্ত্রণা, সারাটা জীবন একা থাকার যন্ত্রণা, এই যন্ত্রণা বড় কঠিন। জীবন, যৌবন, সৌন্দর্য, আবেগ, সমস্ত এক লহমায় মিথ্যে হয়ে যাওয়ার যে যন্ত্রণা, তা ভাবনার বাইরে। সব অনুভূতি, সব ইচ্ছা, সমস্ত বাসনা, বৃষ্টি হয়ে আছড়ে পড়ে মাটিতে, আর অবহেলায় পড়ে থেকে কখন যে মিলিয়ে যায়, কেউ জানতেও পারে না।
“…বিজুরিয় চমকাত ডর লাগাত হ্যায়,
সুনা সুনা ঘর লাগাত হ্যায়…
সখী রি, সাওয়ান ভাওয়াত নাহি…”