হলদে ওড়না

কয়েকদিন ধরেই আর্যর গতিবিধি ভাল ঠেকছিল না রূপসার । অফিস থেকে প্রায় প্রতিদিনই দেরি করে ফেরে । জিজ্ঞেস করলে বলে ওভারটাইম করছিলো । কিছুতেই বিশ্বাস হয়না রূপসার । কাল আর্যর এক কলিগকে ফোন করেছিল ও । সে বললো অফিস থেকে তো ঠিক সময়ই বেরিয়ে যায় আর্য । সন্দেহটা দৃঢ় হলো রূপসার । দুপুরে ছাদে বসে ভাবছিল রূপসা , কেন এরকম হচ্ছে ? আর্য কি তাহলে কারো সাথে প্রেম করছে । চোখের কোনে এক বিন্দু জল চলে এলো ওর । আর্য তো এমন ছিলোনা , কত ভালোবাসতো ওকে , ওর খেয়াল রাখতো । এখন তো সবসময় অন্যমনস্ক । আর ভাবতে পারছিল না রূপসা। ছুটে গিয়ে বালিশে মুখ চেপে শুয়ে পড়লো ।

আজ আরেকটা অদ্ভুত কান্ড ঘটেছে । রাতে আর্যর অফিসের ব্যাগ থেকে টিফিনকৌটোটা বের করতে গিয়ে দেখল একটা ডায়রি । থমকে গেল রূপসা , আরে এটাতো ওরই কবিতার ডাইরিটা । এটা আর্য ব্যাগে নিয়েছিল কেন । আর্য তো কোনোদিন ওর একটা কবিতা পড়েও দেখেনি । ছুটে গিয়ে আর্যকে বলতে বললো , ” ঐ অফিসের ফাইলের সাথে ভুল করে ঢুকে গেছে হয়তো । ” রূপসার মনটা কিন্তু খুঁতখুঁত করতে লাগলো । কি হচ্ছে এসব ওর সাথে !

আর্য অফিসের জন্য তৈরি হচ্ছিলো যখন , রূপসা আড়াল থেকে ওকে লক্ষ্য করছিলো । আর্য আলমারি খুলে রূপসা পুরোনো হলদেটে ওড়নাটা নিয়ে , একবার চারিদিক দেখে ব্যাগে ঢোকাল । তখন আর্যর চোখেমুখে একটা লুকোনোর ছাপ স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছিল রূপসা ।
আর্য বেরিয়ে গেল । মিনিট সাতেক পর বেরোলো রুপসাও । একটা ট্যাক্সি নিয়ে আর্যর গাড়িটা ফলো করতে শুরু করলো । গাড়িটা অফিসের দিকে না গিয়ে হাজরার দিকে যাচ্ছে । আর্য বেশ জোরে চালাচ্ছে । পেছনে রূপসা । গাড়িটা গিয়ে ঢুকলো চিত্তরঞ্জন ক্যান্সার হাসপাতালে । রূপসা গেটের কাছে গিয়ে ট্যাক্সিটা ছেড়ে দিলো । আর্যর পিছু নিলো সে । আর্য একটা কেবিনে ঢুকলো । রূপসা গিয়ে দরজার কাচ দিয়ে দেখলো । ভেতরে ঢুকেই আর্য মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়লো । আর্য কাঁদছে । বেডে একটা নিথর দেহ । মুখটার দিকে তাকাতেই রূপসার পায়ের তলার মাটি সরে গেল । ও আর সামলাতে পারলো না । হাসপাতালের মেঝেতেই বসে পড়লো । তারপর আর কিছু মনে নেই রূপসার ।

বিকেলে সব কাজ মিটে যাবার পর গাড়িতে করে ফিরছে রূপসা আর আর্য । রূপসা শুন্যের দিকে তাকিয়ে আছে । গাড়ির ভেতরে নিস্তব্ধতা খাঁ খাঁ করছে । আর্যই নীরবতা ভাঙলো । বললো , ” মাসখানেক আগে একটা ফোন এসেছিলো । শুভমের। প্রথমটায় পাত্তা দেইনি । পরদিন আবার ফোনটা এলো । তোমার কথা বললো । তারপর বলে আমার সাথে নাকি দেখা করাটা খুব জরুরি । তুমিতো আমায় শুভমের কথা বলেছিলে আগেই । তাই সেদিন অফিসের পর হাসপাতালে গেলাম । দেখো রূপসা , তুমি ভুল করেছিলে একটা । তুমি ভুল বুঝেছিলে শুভমকে । বিয়ের প্রতিশ্রুতি দিয়ে ও পালায়নি রূপসা । তোমায় ভালোবেসেছিল বলেই চলে গেছিলো নিজের ক্যান্সারের খবর শুনে । ও জানতো এই পৃথিবীতে আর কয়েকটা দিনের অতিথি । তাই চলে গেছিলো ও । কারো সাথে সম্পর্ক রাখেনি । তার প্রায় এক বছর পর আমাদের বিয়ে । গৌহাটি থেকে এক মাস আগে কলকাতার হাসপাতালে আসে ও । যে শহরে প্রথম নিঃশ্বাস নিয়েছিল সেখানেই শেষ নিঃশ্বাস ছাড়ার আশায় । এসেই তোমার স্মৃতি আঁকড়ে ধরে ওকে । এক বন্ধুর মাধ্যমে আমার নম্বর জোগাড় করে ফোন করে আমায় । ওই তোমাকে বলতে বারণ করেছিল । ওর কথাতেই তোমার কবিতার খাতাটা নিয়ে গেছিলাম । একদিন রেখে ফেরৎ দিয়ে বলেছিলো হলদেটে ওড়নার কথা । ওই ওড়নাটা নিয়েই নাকি ও স্বর্গে যাবে । মৃত্যুপরবর্তী জীবনটা কাটাবে ঐ ওড়নাটার সাথে । দিতে পারলাম নাগো , তার আগেই চলে গেলো ;  ” , আর্যর চোখে জল । গাড়িটা থামালো আর্য । রূপসা তখনও একটা কথাও বলেনি । ফর্সা গালদুটো ভিজে গেছে চোখের জলে ।

আর্য জড়িয়ে ধরলো রুপসাকে । রূপসা আর্যর শার্টটা খাঁমচে ধরে চিৎকার করে কাঁদছিল । হলদে ওড়নাটা তখন জানলা দিয়ে উড়ে পড়লো ব্যস্ত রাস্তায় । মুহূর্তে গাড়ির চাকায় ছিন্নভিন্ন হয়ে গেলো – ওড়নাটা না শুভমের ভালোবাসা ?

Facebook Comments Box

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *