আজ পাঁচ বছর পর নিজের বাড়িতে ফিরে দরজাটা খুলতেই মিঠির চোখ পড়ল দেওয়ালে টাঙানো ছবিটার দিকে, যে ছবিটা রাঙিয়েছিল মনের ইচ্ছেরা! একটা মেয়ের ছবি, মেয়েটা একমনে ছবি আঁকছে রঙ মেখে, সমস্ত জগৎ ভুলে…
ছবিটা শুধু ছবি ছিল না আসলে, মিঠির ডায়েরির পাতায় সযত্নে লালন করা একটা ইচ্ছে ছিল ওটা!
আজ এতদিন পর ছবিটাকে আবার দেখে একচিলতে হাসি ফুটল ওর মুখে। ফ্ল্যাশব্যাকে পুরনো স্মৃতিগুলো মিঠির চোখের সামনে ভিড় করে আসছিল—
মিঠি ছোটো থেকেই ছবি আকাঁয় ছিল নিপুণ। ওর একটাই স্বপ্ন, ও আর্টিস্ট হবে, কিন্তু, একটা দুর্ঘটনা ওর স্বপ্নগুলোকে দুমড়ে মুচড়ে শেষ করে দিয়েছিল।
ঘটনাটা ঘটেছিল মিঠির উচ্চমাধ্যমিকের পরের ছুটিতে। বন্ধুদের সাথে সারাদিন ঘুরে ফেরার সময় আচমকাই অ্যাক্সিডেন্ট করে ওর স্কুটিটা। হাসপাতালে পনেরো দিন জীবনমরণ যুদ্ধের পর মিঠি প্রাণে বেঁচে গিয়েছিল ঠিকই, কিন্তু ওর ডান হাতের নার্ভগুলো অচল হয়ে পড়ে।
মিঠির চোখে ভাসছিল হাসপাতালের বেডে বসে অঝোরে কাঁদতে থাকা সদ্যযৌবনা ওই অসহায় মেয়েটার মুখ। নিজের স্বপ্নের মৃত্যু নিজের চোখে দেখাটা বড্ড কঠিন ছিল সেদিন।
সেই দুঃস্বপ্নের মুহূর্তে দুটো হাত এসে শক্ত করে ধরে নিয়েছিল ওর হাতটা, ভেঙে পড়ার প্রতিটা মুুুুহূর্তে আগলে রাখছিল নিজেদের সবটুকু দিয়ে।
মানুষদুটো ছিল ওর মা আর বেস্টফ্রেন্ড সাম্য। যে সময়টায় ও আর কোনোদিন ছবি আঁকতে পারার আশা ছেড়ে দিয়েছিল, সেই সময় ওকে নিয়ে ব্যাঙ্গালোরে নামী ডাক্তারের কাছে ছুটেছিল এই দুটো মানুষ।
মিঠি যখন প্রতিদিন ওই ফ্রেমটা আকঁড়ে কাঁদত বালিশে মুখ গুঁজে, মাঝে এসে হাত বুলিয়ে দিত মাথায়; ওকে বোঝাতো, “this is not your story.” মায়ের ওই নরম আঁচলটা আর ওকে ভালো করে তোলার অদম্য চেষ্টা মনে জোর যোগাত অসুস্থ মিঠির।
অচল হাতটা দিয়ে ও যখন বারবার পেনসিল ধরতে গিয়ে ব্যর্থ হত, ওর হাত ধরে ছবি আঁকানোর চেষ্টা করত সাম্য।
ওরা হেরে যাওয়া মিঠিকে দেখতে চায়নি, ওরা পাশে ছিল বলেই মিঠির স্বপ্নটা মরতে মরতেও বেঁচে রয়েছিল ওর বুকের মাঝে।
হাসপাতাল থেকে ফেরার পর থেকে একটা নতুন অভ্যেস করেছিল ও, রোজ ধ্যানের অভ্যেস… কারণটা ছিল মনের জোর বাড়ানোর চেষ্টা। রোজ নতুন ব্যায়াম, মেডিসিন আর মনের জেদ ওর অচল হয়ে পড়া নার্ভগুলোয় একটু একটু করে শক্তি ফেরাচ্ছিল। একটা করে দিন এগোচ্ছিল আর ওর মুখে হাসি ফিরছিল ক্রমশ…
আসলে একটা জেদ চেপে গিয়েছিল মিঠির মনে, হার না মানার জেদ। মনের কোণে কোথাও কেউ ওকে বলছিল কিছু সময় নিজের ইন্সপিরেশন নিজেকেই করতে হয়, আর ওকে সাহস দিত ওর নিজের আঁকা ওই ছবিটা। ছবিটা ওকে যেন হাতছানি দিয়ে ডাকত ওর স্বপ্নপূরণের পথে এগিয়ে চলার জন্য!
দীর্ঘ একবছরের লড়াইয়ের পর মিঠি আবার ছবি আঁকতে পারে নিজের হাতে, ভেঙে যাওয়া স্বপ্নটাকে আবার যত্নে লালন করতে থাকে। আর সেদিন যে দুটো মানুষ সবচেয়ে খুশি হয়েছিল ওকে আগের মত হাসতে দেখে তারা ছিল সাম্য আর ওর মা, যাদের ছাড়া মিঠির যুদ্ধটা হয়তো সফল হত না। আর, আজকে মিঠি নিজের স্বপ্নের জগতে প্রতিষ্ঠিত, ও ভালো আছে…
এমন সময় মায়ের ডাকে ওর চিন্তার রেশ কেটে গেল। মা তাড়া দিচ্ছে, একটু পরে ওদের বেরোতে হবে, অ্যাকাডেমি অফ ফাইন আর্টসে যেতে হবে। মিঠি পুরস্কার পাচ্ছে আজকে ওখানে সেরা উদীয়মান অঙ্কনশিল্পীর। সেই চিকিৎসার জন্যে ব্যাঙ্গালোরে যাওয়ার পর ওর ওখানেই আর্ট কলেজে ভর্তি হওয়া, আর তারপর কেরিয়ার গড়ে তোলা দিল্লিতে। পাঁচ বছর পর ওর কলকাতায় ফেরা বিশেষ আমন্ত্রণে এই পুরস্কার পাবে বলে।
তৈরী হয়ে অ্যাকাডেমির পাঠানো গাড়িতে করে গন্তব্যের দিকে এগিয়ে চলে মিঠি, আর মনে মনে স্থির করে নেয়— আজকে মঞ্চে ও সকলের সাথে ভাগ করে নেবে ওর লড়াইয়ের গল্পটা, কে জানে হয়তো ওর কথা শুনে অন্য কোনো মিঠি ফিরে পাবে নিজের মনের জোর, খুঁজে নেবে ইন্সপিরেশন, নতুন করে এগিয়ে যাবে নিজের স্বপ্নপূরণের পথে।
শুধু, জীবনযুদ্ধের প্রতিটা দুর্বল মুহূর্তে মনে রাখতে হবে Robert Frost-এর কবিতাটার শেষ লাইনগুলো—
“But I have promises to keep,
And miles to go before I sleep…”