31st নাইট বা যাকে বলি “নিউ ইয়ার ইভ”; বছরের শেষ সূর্যটা তার সমস্ত শক্তি দিয়ে শেষ-ইচ্ছেগুলোকে ছড়িয়ে দেওয়ার প্রবল চেষ্টা করে যাচ্ছে। ডিসেম্বরের কলকাতা, শীতের চাদরের তলায় সমস্ত শহরটা শান্ত। এই ডিসেম্বরেই কলকাতা ও তার আশেপাশের সমস্ত কিছুর প্রাণকেন্দ্র হয়ে ওঠে “পার্কস্ট্রিট”। Christmas থেকে যে উৎসবের সূচনা হয় তা নিউ ইয়ারের দিন পর্যন্ত চলে। রাস্তাঘাট থেকে রেস্তোরাঁয় নতুন বছরের উত্তেজনার আলো ঝলমল করে। এই নিউ ইয়ার ইভের বিকেলে, সূর্য অস্ত যাওয়াতে আলোর খুব বিস্তর পার্থক্য বোঝা যায়না; চারিদিকের চিৎকার ও ভিড়ে শীত বলতে যা কিছু ছিল তা মিথ্যা মনে হয়।
এমনিই এক উদ্দীপ্ত পার্কস্ট্রিট বিকেলে যেখানে সমস্ত কলকাতা ধরা দিয়েছে, তারই একেবারে মধ্যেখানে শহরের উল্লাস, উত্তেজনাকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে “South Park Street Cemetery”। এই Cemetery বা কবরস্থানটি কলকাতার বুকে সবচেয়ে পুরনো কবরস্থানগুলির মধ্যে একটি। শোনা যায়, উনিশ শতকে ইউরোপ ও আমেরিকার বাইরে এটিই সবচেয়ে বড় কবরস্থান। বর্তমানে টুরিস্টদের কাছে এটি খুব জনপ্রিয় হলেও বিকেলের পর কারও দেখা মেলে না। নিউ ইয়ার ইভের রাতে শহরের বিমুখে “মাদার টেরেসা সরণী” বেয়ে এমন একটি জায়গা কারও গন্তব্য হবে এটা ভাবনারও অতীত। শহরের কোলাহল থেকে নিজেকে বাঁচিয়ে স্যুটকেস হাতে একটি শরীর ধীর গতিতে হাঁটতে হাঁটতে Cemetery-র ভিতর প্রবেশ করছে। Cemetery-র ভিতরের হালকা আলোতে যেটুকু চোখে পড়ে তাতে লোকটার বয়স তিরিশ কি তার বেশি, গায়ে ফুলহাতা জ্যাকেট আর নীচে ছেঁড়া জিনস ও হাতে পুরনো দিনের একটি স্যুটকেস বিশেষ।
সমস্ত “পার্কস্ট্রিট”-এ শান্তি বলে শব্দের যখন হাজত বাস, সে মতো অবস্থায় এই জায়গাটা ছিল তেমনিই নিশ্চুপ ও শান্ত। কোথাও বিশৃঙ্খল কোথাও ভগ্ন অবস্থায় পরে থাকা ইন্দো-ইসলামিক ধাঁচের সৌধগুলোর থেকেও এই জায়গাটাকে নির্জন ও অন্ধকার করে তুলেছে তা এই বহু বৎসরের পুরনো গাছ ও আগাছাগুলো। শ্যাওলাগুলোও সৌধগুলোকে যেন রঙের প্রলেপ দিয়েছে; তাতে চারিদিকে কালো বাদে আর কিছু চোখে পড়েনা। চারিদিকের স্তব্ধ নির্জনতা ভেদ করে স্যুটকেস হাতে শরীরটা এগিয়ে চলেছে। প্রায় কবরস্থানের মধ্যেখানে গিয়ে লোকটি সুটকসটা মাটিতে রেখে ভিতর থেকে কয়েকগুচ্ছ ছবি বের করল। প্রতিটা ছবিতে ভিন্ন ভিন্ন মুখ। কোনোটা মাঝ বয়সী ছেলের, কোনোটা চোয়াল ভাঙ্গা বৃদ্ধের, কোনোটি আবার খুব সুন্দরী, আবার কোনোটি বাচ্চা মেয়ের। লোকটা এইসব ছবিগুলো উল্টেপাল্টে দেখে যাচ্ছিল।
এমন করে বেশ কিছুটা সময় কেটে গেল। দূরের অন্ধকার থেকে কয়েকজনের এগিয়ে আসার শব্দ পাওয়া গেলো। লোকটা তখন ছবিগুলো দেখে যাচ্ছে। এগিয়ে আসার শব্দ ক্রমশ বেড়েই চলেছে, লোকটি তখনও মাথা তোলেনি ছবিগুলো থেকে। যেন সমস্তটাই তার জানা। অন্ধকার পেরিয়ে লোকটির সামনে আসতে প্রত্যেকেই এক একটি ছবি তুলে নিল। ছবিগুলো হাতে নিতেই শীতের রাতের পারদ যেন আরও নীচে নামল, স্ট্রিট লাইটগুলো তাদের আয়ু শেষের মিথ্যা আর্জি জানালো। এরই মাঝে ছবিগুলোর ভিতরের মানুষেরা বাস্তবে দেখা দিতে লাগল। ছবিগুলোতে যেরকম ছিল ঠিক সেই অবস্থায় দেখা দিল। লোকটি তখনও মাথা নীচু করে দাঁড়িয়ে, যেন সবটাই জানা তার। ছবির থেকে বেরিয়ে আসা মানুষগুলো আর সেই ছবিগুলো ধরে থাকা মানুষগুলো একে অপরকে দেখে কিছু বলার আগেই তাদের দুঃখগুলো জ্বর বাঁধিয়ে চিৎকার করছে। সে চিৎকারে দুজন এতটাই ভীত যেন নিজেদের আর দেখতে পাচ্ছেনা। তাদের শরীর যেন তাদের কোনো কথাই মানছে না। হঠাৎই চিৎকার গেল থেমে, একে অপরের দিকে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। যেন কতকিছু বলছে, কোনো বিষাক্ত অতীত ভোলাচ্ছে, কত অজানা ঝগড়ার মীমাংসায় মেতেছে। তারা কাঁদতে শুরু করেছে। চোখের জলগুলো প্রতিধ্বনির ভিড়ে হারিয়ে যাওয়া শব্দদের ফিরিয়ে আনছে।
যেসব বহু পুরনো প্রতিশ্রুতিদের জ্যান্ত কবর থেকে তুলে এনে তাদের শেষবারের জন্য মিথ্যা বলতে বাধ্য করা হচ্ছে। যে শেষ মিথ্যায় তাদের চিরকালীন বিচ্ছেদের সম্মুখীন হতে হবে। তাদের দেখা হবে না আর। তাদের বিচ্ছেদের চিৎকার যেন পার্কস্ট্রিটের চূড়ান্ত শব্দকেও হার মানায়। এরকম ভাবেই প্রবল চিৎকারে ছবি থেকে বেরিয়ে আসা মানুষগুলো ধ্বংসের পথে এগোয়। শরীরগুলোতে ফাটল ধরতে থাকে। তারপর সেই চিৎকারে শরীরে বিস্ফোরণ হয়, তাদের শরীর বলতে কিছুই থাকে না আর। ছবিগুলো হাতে নিয়ে নিথর দাঁড়িয়ে আছে তারা। বহু পুরনো বিষাদ আজ কবরে। কিন্তু তাও তারা শান্তিতে নেই। এতগুলো বছর বিষাদ বুকে নিয়ে থাকাতেও যেন শান্তি ছিল, তাদের প্রিয় মানুষরা যেন তাদের সাথে ছিল। কিন্তু আজ তাদের বেঁচে থাকার সময়ের পছন্দের মানুষগুলো শেষ হিসেব মেটাতে এসেছিল সুটকেসবাহি লোকটির হাত ধরে। ছবিগুলো ফেরত দিয়ে তারা আবার অন্ধকারে মিলিয়ে গেল। লোকটি ছবিগুলো বাক্সে তুলে নিল। তারপর এক দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে আপন মনেই যেন বলতে লাগল—
“All my sins need holy water, feel it washing over me…”