আমি তিতির (শেষ থেকে….. )
( আমার নাম বোধহয় তিতির। আমার বয়স ১৮। আমি ছোটো থেকে social anxiety disorder-এর শিকার। আমি ভাবতে ভালোবাসি আর এটা আমার গল্প। )
আমি এখন ঠিক কত উঁচুতে দাঁড়িয়ে আছি জানিনা। ৩০ কি ৩৫ তলা হবে বোধহয়। এত উপর থেকে শহরটাকে অনেকটা কাছের লাগছে। একেবারে রেলিংয়ের ধারে দাঁড়িয়ে জীবনটাকে দেখছি। মা বোধহয় জানেনা, জানলে আর দেখতে হতো না। যাই হোক এত উঁচুতে দাঁড়িয়েও খালি নীচের দূরত্বটা মাপার ইচ্ছে বেড়েই চলেছে। খালি মনে হচ্ছে এই যে মানুষ সারাজীবন শুধু উঁচুতে ওঠার জন্য এত লড়াই করে, পরিশ্রম করে তারা কি কখনো ভেবেছে, যে যতটা উঁচুতে উঠছি ঠিক ততটাই দূরত্ব নীচের সাথে বেড়ে— আরে, কীসব ভাবছি? ধুর আমিও না কীসব ভাবছি। এবার যাওয়ার পালা— এক পা আগে করলাম রেলিং থেকে, তারপর…
— ‘অ্যাই তিতির, তিতির…’
(গলাটা চেনা চেনা লাগছে খুব কোথায় যেন শুনেছি, আরে এটা মায়ের গলা।)
— ‘তিতির, কী হয়েছে তোর?চোখ খোল মা।’
আমি ধড়ফড় করে উঠে পড়লাম। চারপাশটা দেখলাম, সেই চারটে দেওয়াল, কিছু বই খাতা, টেবিল চেয়ার আর বিছানার উপর আমি আর আমার ডায়েরি। আর অতি অবশ্যই আমার মা জননী।
— তুই আবার উল্টোপাল্টা স্বপ্ন দেখছিলি না? আমি জানি আজই তুই আমার সাথে ডাক্তার রায়ের কাছে।
— না মা পারছি না। আমি একটু বেরোবো।
— মানেটা কী, হ্যাঁ? আর একটু পরে সন্ধ্যা নেমে যাবে, শীতের বেলা। এই পাগলামিগুলো না করলেই নয়? আমার আর কি শুধু শুধু চিন্তা…
(ওই শুরু হল এক্ষুনি না থামালে এটা চলতে থাকবে।)
— মা আমি তাড়াতাড়ি ফিরে আসবো, চিন্তা করার কোনো দরকার নেই। আর আমি বাচ্চা নই।
— সেই তো আমি আর কেন চিন্তা করবো। খুব বড়ো হয়ে গেছিস তো। খুব বড়ো বড়ো কথা বলতে শিখেছিস। মায়ের মন কি বুঝবি!
— মা আমি এলাম। তাড়াতাড়ি ফিরে আসবো। টাটা।
(উফফফ্, মাথা ধরিয়ে দিল। পেছন থেকে এখনো মা চেঁচিয়ে যাচ্ছে।)
— যান না যান। যেখানে পারেন যান।
মা এখনো সমানে চেঁচিয়ে যাচ্ছে । উফফফ সত্যি মহিলা বটে। শীতকালের বিকেল কখন ঝপ করে সন্ধে নেমে আসে, ঠিক যেমন মৃত্যু। আজ আর ট্যাক্সি ধরবো না। ফুটপাতেই হাঁটি বরং।
(ফুটপাতগুলো না আমাদের জীবনের মতোই সরু হয় আবার রাতের অন্ধকারে একলাও হয়ে যায়। শহরের রাজপথের মতো সাজগোজ করতে পারে না। আমাদের জীবনের ফুটপাতগুলো না একটু ওলটানো, কোনোটা পালটানো থাকে আর আমরা সেটাতে চলতে না শিখে সারাজীবন এটাই ভেবে কাটিয়ে দিই কবে সোজা, সহজ ফুটপাত পাবো। আমরা ভুলে যাই যে, সোজা রাস্তা হয়তো আমাদের শান্তি দিতে পারে কিন্তু ঠিক ভুলের তফাৎ শেখাতে পারে না। এইভাবে আমরা সোজা ফুটপাত ধরে, জীবনের শেষধাপে এসে দাঁড়াই, সামনে থাকে ক্রসিং যেটা পার করে আমাদের অন্য ফুটপাত মানে অন্যজীবনের গল্প শুরু হয় আর হাতে রয়ে যায় শুধু ভিড় ঠেলে বেঁচে থাকার গল্প যেখানে বসন্তকালে শুধু ঘামে ভেজা মানুষের গল্প…)
আরে একি আমি তো কখন ফুটপাতের শেষে চলে এসেছি খেয়ালই করিনি। সিগন্যালটা সবে লাল হয়েছে, কাউন্টডাউন দেখাচ্ছে আর ৪০ সেকেন্ড বাকি। গাড়িগুলোও যেন একেবারে জীবনের শেষলগ্নের অপেক্ষায়। কেমন লাইন দিয়ে দাঁড়িয়ে, যেন কেউ হাত জোর করে ধরে রেখেছো। এই দেখেছো আমাকে রাস্তাটা পার করতে হবে আমি ভুলেই গেছি। আর ১০ সেকেন্ড বাকি— ১০, ৯, ৮…
এইদিকের ফুটপাতটা ধরে কিছুটা গেলে শেষে একটা ছোট্ট নদী পড়ে, নদীর ধারে একটা ছোট্ট শ্মশান আছে, এখন খুব বেশি ব্যবহার হয়না। মাঝেমাঝে দু-একটা আসে। জায়গাটা বেশ শান্ত, চুপচাপ। মা অবশ্য জানে না যে আমি এখন পার্কের বদলে এখানে আসি, জানলে আর দেখতে হবেনা। ভীষণ সাংঘাতিক মহিলা উনি…
এখন বিকেল গড়িয়ে সন্ধে নামবো নামবো করছে। আমি শ্মশানের ভেতর একটা ভাঙাচোরা বেদীর উপর বসে আছি, না শুধু বসে নেই, কী একটা দেখছি। কী দেখছি যেন? ও হ্যাঁ, সবে দাহ হয়ে যাওয়া একটা চিতা। এখনো ধিকি ধিকি করে জ্বলছে।
(চারিদিকটা কেমন অদ্ভুত শান্ত, যেন কেউ মুখে কাপড় বেঁধে চুপচাপ প্রতিবাদ জানাতে চাইছে। মাঝেমাঝে কেমন একটা ঠাণ্ডা বাতাস চুলগুলো উড়িয়ে নিয়ে যেতে চাইছে। সারাজীবন ধরে কত কিছু দেখে এখন বিশ্রাম নেওয়ার পালা চলছে। সঙ্গে একটু আগুনের উষ্ণতা। আমরা সারাদিন কতকিছু করি— খাই-দাই, অফিস যাই, ঘুমোই, গল্প করি, আরো কত কি! কিন্তু কখনো ভাবি না যে একদিন ওই শুকনো কাঠের মধ্যে চাপা পড়বো, দম নিতে পারবো না, নাকে তুলো গুঁজে দেবে তারপর ব্যস— আমরা আসলে জীবনের মাঝপথটাতে বেশি সময় কাটাই কারণ শুরু আর শেষ তো সময়ের আচমকা হয়। আসলে না মানুষকে যুদ্ধ করাটা শিখতে হবে, হেরে গেলে অন্তত বলতে পারবো আমি যুদ্ধে বুক চিতিয়ে লড়াই করেছিলাম। তারপর আবার উঠে দাঁড়িয়েছি ঠিক যেমন রোজ অন্ধকারের সাথে সূর্য আর কুয়াশার সাথে ঠাণ্ডা। চারিদিক সত্যিই শান্ত, চিতার আগুনটাও বোধহয় ফুটপাতের শেষের দিকে। ঝিঁঝিঁর ডাক শুরু হয়েছে। বাতাসে অদ্ভুত গন্ধ ভেসে বেড়াচ্ছে যেটাকে মড়া পোড়ার গন্ধ বলে। কতযুগ ধরে কত মানুষ এই জায়গায় এসে জীবনের শেষ বিশ্রাম নিয়েছে, হয়তো আমার মতো তারাও একবার আকাশের দিকে তাকিয়েছে, পিছনে ফেলে আসা ফুটপাত।)
না সন্ধে হয়ে গেছে, এবার ফিরতে হবে। এখন আবার সেই ফুটপাতের উপর। পেছন থেকে শোনা যাচ্ছে— “বলো হরি, হরি বোল…”। বোধহয় আবার কেউ…
(না তিতির এখন বেঁচে নেই। অনেকদিন আগেই মারা গেছে। এটা তিতিরের বেঁচে থাকা অবস্থায়, গুরুত্বহীন শেষের কিছু কথা।)