ঘড়িতে সবে রাত ন’টা বেজে সাত। আমি হুড়মুড়িয়ে ওয়ার্ডের গেটের সামনের ভিড়টাকে ঠেলে ওয়ার্ডে ঢুকে পড়লাম। দ্রুত পায়ে লেবার রুমে পৌঁছাতে আরও মিনিট খানেক। তুহিনাদি একবার কড়া দৃষ্টিতে আমাকে মেপে নিল, বুঝলাম আট মিনিট লেটের খেসারত দিতে হল বলে। আমি শ্রীতমা। একটা ডিস্ট্রিক্ট হাসপাতাল আর মেডিক্যাল কলেজের ইন্টার্ন। এখন আমার পোস্টিং চলছে প্রসূতি বিভাগে। তুহিনাদি আমাদের ইউনিটের হাউসস্টাফ। অসম্ভব পাংকচুয়াল আর কাজপাগল। ইউনিট হেড মহুয়া ম্যাম তুহিনাদি কে বেশ ভরসা করেন। লেবার রুমে ঢুকে দেখি রজত আর মৈনাক, আমার ব্যাচমেট এবং বর্তমান কো-ইন্টার্ন দুজনে কেউই এখনও এসে পৌঁছয়নি, এদিকে টেবিলে প্রায় জনা দশেক পেশেন্টের ফাইল জমা হয়েছে। এরা সবাই কমবেশি লেবার পেইন নিয়ে এসেছে। প্রত্যেককে একে একে ডেকে পরীক্ষা করে দেখে উপযুক্ত নির্দেশ দেওয়া বা প্রয়োজন মত ওষুধপত্র দিতে হবে যতোক্ষণ না সন্তান প্রসব হচ্ছে। তার পাশাপাশি যাদের প্রায় প্রসবের সময় উপস্থিত, তাদের সঠিকভাবে প্রসব করানো, সিজারিয়ান সেকশনে স্যার বা ম্যামদের ওটিতে অ্যাসিস্ট করাও আমাদের ডিউটি। আমি চট করে সাথের ব্যাগটা লেবার রুমের ডক্টরস্ লকারে রেখে এক এক করে নাম ডেকে পরীক্ষা করা শুরু করলাম। এর মধ্যে রজত আর মৈনাকও এসে পড়ছে। মহুয়া ম্যাম ওয়ার্ডে রাউন্ড দিচ্ছেন। সবমিলিয়ে লেবার রুম ও তার লাগোয়া গাইনি ওয়ার্ড সরগরম।
মিনিট পনেরো বাদেই পেশেন্ট অ্যাডমিশনের রুম থেকে গ্রুপ ডি কর্মী দয়াল দা হাঁপাতে হাঁপাতে এসে হাজির, ” ম্যাডাম, পেশেন্ট খুব খারাপ, খুব ব্লাড গেছে।” দয়াল দার পেছনে স্ট্রেচারে যে শীর্ণকায় হবু মা টি শুয়ে আছে, তার চারপাশ তখন সত্যিই রক্তে ভেসে যাচ্ছে। সঙ্গে আর একজন মাঝবয়সী মহিলা, হাতে একটা বোঁচকা নিয়ে ক্রমাগত নেতিয়ে পড়া প্রসূতিটিকে আশ্বাস দিয়ে চলেছেন। পেশেন্টের নাম চাঁপা। সঙ্গের মহিলা মনে হয় ওর মা। ভদ্রমহিলার নাম সনকা, সেই নামেই বাংলায় স্বাক্ষর করা হাই রিস্ক কনসেন্টে। তুহিনাদি ও ছুটে এসেছে। আমাদের দেখে সনকা দেবী হন্তদন্ত হয়ে এগিয়ে এলেন।
-” আমার বিটি কে বাঁচাও মা গো, বিকেল থেকে খালি রক্ত ভাঙছে, ভ্যানে করে আনতে অনেক সময় লেগে গেল।” মহিলা ডুকরে উঠল।
পেশেন্টের অবস্থা সত্যিই ক্রমে অবনতি হচ্ছে। এখুনি অপারেশন করা প্রয়োজন, ব্লাড ও জোগাড় করতে হবে। সে কথা মহিলাটিকে বুঝিয়ে বলা হল। অপারেশনের নামে সনকা দেবীর মুখ ফ্যাকাশে হয়ে গেল। বললো, ” অপারেশন করতেই হবে গো দিদিমণি? অন্য ভাবে হবেনি?”
-” অপারেশন না করলে যে মা বা বাচ্চা কাউকে বাঁচানো যাবেনা।”
-“আমার বিটি আর ওর পেটের টার কিছু হবেনি তো?”
-“আমরা যথাসাধ্য চেষ্টা করব মাসিমা, তবে অনেক রক্ত বেরিয়ে গেছে তো, আর দেরী করা যাবেনা।”
-” তোমরা যা ঠিক বোঝো তেমন করো, ওরা যেন ভালো হয়ে যায় দেখো।” মহিলার চোখেমুখে অসহায়তা স্পষ্ট, মেয়ের জন্যে মা এর মন কেঁপে উঠছে, সেটাই স্বাভাবিক।
ওটি আগেই রেডি করা হয়ে গেছিল। মহুয়া ম্যাম ও চাঁপাকে ইতিমধ্যেই পরীক্ষা করে দেখেছেন, উনিও তৈরি ওটির জন্যে। একটু পরেই অপারেশন শুরু হবে। ব্লাড আর কিছু ওষুধপত্র আনার ছিল। সনকা দেবীকে সেইসব কাগজ হাতে দিয়ে বললাম, ” মাসিমা, এগুলো নিয়ে আসতে হবে তাড়াতাড়ি, আপনাদের সাথে কোনো পুরুষ মানুষ আছে তো? তাকে বলুন এগুলো নিয়ে আসতে।”
-” বেটাছেলে তো কেউ নেই, আমিই এসেছি, আমাকে দাও আমি আনছি।”
-” সেকি আপনার জামাই আসেনি? এতটা পথ এত অসুস্থ মেয়েকে নিয়ে একাই চলে এলেন? পথে বিপদ হলে?”
-” ছেলেটা আমার একদম অপগন্ড মা, সে আর কি আসবে সাথে। সারাদিন মদ গিলে পড়ে থাকে, আর ঘর এসে আমাকে, বউটাকে পেটায়। আগের দুটো তো এই করে পেটেই নষ্ট হল বউটার। বউ আমার বড় ভালো, আমাকেও মানে খুব…।” ওনার গলা কান্নায় বুজে এল এবার।
-” চাঁপা আপনার বউমা বুঝি?” এবার আমার অবাক হওয়ার পালা। পুত্রবধূর জন্যে শাশুড়ির এমন টান আজও বড় একটা চোখে পড়েনা।
সনকা দেবী নিজেই একা সব বন্দোবস্ত করলেন। চাঁপার অনেক কম্প্লিকেশনস ছিল, অপুষ্টি, নিয়মিত চেকআপ এর অভাব, উপরন্তু আগের দুটো মিসক্যারেজ। বাচ্চাটাকে বাঁচানো আর সাথে মা কেও সুস্থ রাখা আমাদের কাছে একটা বড় চ্যালেঞ্জ। মহুয়া ম্যাম একজন ভীষণ এফিশিয়েন্ট গাইনোকোলজিস্ট। এ যাত্রায় চাঁপা আর তার শিশুসন্তান দুজনেরই প্রাণরক্ষা হল। একটা ফুটফুটে শিশুকন্যার জন্ম দিল চাঁপা। নাতনিকে দেখে সনকা দেবীর সেকি উচ্ছ্বাস। এখনও গ্রামে গঞ্জে এমনকি বহু ক্ষেত্রে অনেক সুশিক্ষিত পরিবারেও কন্যাসন্তান হলে পরিবারবর্গ দীর্ঘশ্বাস ফেলে। এই মফস্বলের অর্ধশিক্ষিত মহিলা যেন সেই শিক্ষিত জনসমাজের বিরুদ্ধে একা প্রতিবাদী এক চরিত্র, যিনি কন্যাসন্তান আনমনে নেচে উঠেছেন, বাড়ির বউ এর জন্যে নিজের পুত্রের বিরোধিতা করেছেন। উনি যেন সত্যিই এক দৃষ্টান্ত স্থাপনে ব্রতী হয়েছেন।
সকালে পোস্ট অ্যাডমিশন ডে এর রাউন্ড সেরে আমি, রজত আর মৈনাক সবে ওয়ার্ডের দরজার দিকে পা বাড়িয়েছি হস্টেলে ফিরব বলে, দেখি সনকা দেবী এই সাতসকালেই কোথা থেকে যেন এক ঠোঙা গুজিয়া কিনে এনে ওয়ার্ডে সব সিস্টার দিদি, আয়া মাসি, গ্রুপ ডি দাদাদের খাওয়াচ্ছেন নাতনি হওয়ার খুশিতে। আমাদেরও দিয়ে গেল, আমরা কেউই না করতে পারলাম না। রজত মুখটা আমার কানের কাছে এনে বলল, ” আজ অবধি কাউকে দেখেছিস মেয়ে হয়েছে বলে হসপিটালের সবাইকে মিষ্টি খাওয়াচ্ছে?” আমি কিছু না বলে হাসলাম। রজত ভুল বলেনি, এই দৃশ্য সত্যিই আমাদের হাসপাতালে বিরল।
বিকেলে আমাদের রাউন্ড ছিল। এক এক করে ভর্তি থাকা সদ্য মা হওয়া মহিলা আর তাদের সদ্যোজাতদের হাল হকিকত জানতে জানতে এক সময়ে চাঁপার বেডের কাছে এসে দাঁড়ালাম। চাঁপার মেয়ে তখন ঠাকুমার কোলে নিশ্চিন্তে ঘুমোচ্ছে। চাঁপার ক্লান্ত, শীর্ণকায় চোখে মুখেও এক অদ্ভুত প্রশান্তি। আমাকে দেখে সনকা দেবী উৎফুল্ল হয়ে উঠল,
-” তোমারই অপেক্ষা করেছিলাম গো দিদিমণি, ভাবছিলাম কখন আসবে।”
আমি হেসে বললাম,
-” তা নাতনি কী বলছে?”
-” এ তো শুধু ঘুমায় এখন, আর হাসে মাঝে মাঝে, দেখোনা কতটুকুনটা।” সনকার মুখে প্রাণখোলা হাসি। ” ওকে আশীর্বাদ করো গো দিদিমণি, ও যেন তোমার মত হয়।”
এত সম্মান? আমি সদ্য পাশ করা এক জুনিয়র ডাক্তার, এখনও বহু মানুষ মহিলা ডাক্তারদের ডাক্তার বলে মানতে চাননা, ‘ মেয়েছেলে কি বুঝবে’ জাতীয় কথা আমরা বহুবার শুনেছি, সেখানে এই আধা চেনা মহিলা এত সম্মান দিল?!
ইতিমধ্যেই উনি ওনার বোঁচকাটা থেকে কি যেন বের করে আনল। আমার হাতে ওর মুঠোর জিনিসটা ধরিয়ে দিয়ে বললো,
-” এটা তোমার জন্যে এনেছি, তোমরা আমার বিটি আর নাতনিকে বাঁচিয়েছ। আমি গরিব মানুষ, এটুকুই আমার সামর্থ্য মা।”
আমার হাতে ধরা তখন একটা দশ টাকার ডেয়ারি মিল্কের প্যাকেট আর একটা দুমড়ানো কুড়ি টাকার নোট। আমি বাকরুদ্ধ। কোনোমতে কুড়ি টাকার নোটটা সনকার হাতে গুঁজে বললাম,
-” এটা রেখে দাও, তোমার নাতনিকে আমার হয়ে একটা খেলনা কিনে দিও, আর এই চকোলেটটা আমি রাখলাম, তোমার নাতনি হওয়ার আনন্দে মিষ্টিমুখ করব। ভালো থেকো তোমরা, ও অনেক বড় হবে।”
সনকা আর চাঁপার মুখটা উজ্জ্বল হয়ে উঠল।
রাউন্ড শেষ করে হাসপাতাল থেকে বেরিয়ে আসছি। অনেক দূরে কোথাও মাইকে বাজছে, ” ইয়া দেবী সর্বভূতেষু কন্যারূপেণ সংস্থিতা…” মনে পড়ল আজ মহালয়া। ডিউটির চাপে ভুলেই গেছিলাম। এখন তো মহালয়ার দিনও সারাদিনই কোথাও না কোথাও দেবীবন্দনা শোনা যায়।
‘মা আসছেন’। এক মেয়ে তার বাপের বাড়িতে আসছে। পিতৃপক্ষের অবসান হয়ে সূচনা হল কন্যাপক্ষের। আজ সত্যিই এক মেয়ে সব বাধা পেরিয়ে তার বাপের বাড়ি এল। নাহ, একটু ভুল হল, নিজেকে শুধরে নিলাম। সে তার মা-ঠাকুমার বাড়িতে এল।