আবার একটা রবিবার।
যথা রীতি , রান্না ঘর থেকে আসা গন্ধ মেখে ঘুম ভাঙলো সমুর।
আহঃ! নির্ঘাৎ চিতল মাছের মুইঠা,বুঝত পেরে ,ডাক দিল “ঋতু খুব সুন্দর ওই গন্ধটা..
নিশ্চয়ই মা রান্না করছে না ?!”
“হ্যাঁ শাশুড়ি মাতা রানী এই একটা দিন মন ভরে রান্না করে.. বেশ এই সুযোগে আমারো খানিকটা ছুটি হয়ে যায় ..” ঋতু বললো ।
ঋতু অর্থাৎ, ঋতুপ্রিয়া আর সমু, যে কিনা সম্রাট সিনহা,আজ প্রায় দুবছর হলো ওদের বিয়ে হয়েছে।
এক মাস পরে দ্বিতীয় বর্ষপূর্তি।
এখনো শাশুড়ি রান্নার ভার ছাড়েনি ঋতুর হাতে।রান্নার লোক , সে রোজ রান্না করে দিয়ে যায় , কারণ অতো সকালে উঠে সমু আর ঋতুর অফিস যাওয়ার আগে রান্না করা তপতীর সম্ভব না।নাহলে রোজই তিনিই রান্না করতেন নিঃসন্দেহে।
আজ রবিবার, তার প্রিয় কাজটি করে তাই তিনি সময়টা খুব আনন্দে কাটান।আর বাঙালদের রান্না নিয়ে যা গর্ব ,তা কোনো বাঙালীরই অজানা নয়।
ভোজন রসিক পরিবার , ভাগ্যক্রমে ঘটি পরিবারের শাশুড়ি-বৌমা বাঙাল!
ইস্ট বেঙ্গল আর মোহন বাগান নিয়ে যেমন ঝগড়া একটু ও অস্বাভাবিক নয়, তেমন-ই এই পরিবার এর, দুই দল এর মধ্যে ঝামেলা ও নিত্যদিন এর। হ্যাঁ, শাশুড়ী-বউমার ঝগড়া মনো মালিন্য, কম হলেও, একেবারে যে নেই, তা নয়। তবে বাঙ্গাল-ঘটির লড়াই এ, সবসময় ঋতু কে পাশে পেয়েছে তপতি।
তপতির এক মাত্র ছেলের বউ হিসেবে ঋতু যত না আদর পায়, তার ছেয়ে ঢের বেশী পায় তপতির দলের সৈনিক হওয়ার জন্য,তার মত ডিফেন্ড যে আর কেউ করতে পারেনা।
তবু খাওয়ার নিয়ে তাদের বাড়িতে ঝামেলা হয়না খুব একটা, কিন্তু ফুটবল ম্যাচ থাকলে শূন্য মাঠে অাছড়ে পড়ে হঠাৎ কাল বৈশাখির মত ‘বাঙ্গাল রা বড় না ঘটি রা’ ?
এই রকম কথা উঠলে, বাড়ির আশেপাশে আর কাক চিল বসে আরাম করতে দেখা যায়না।
শুঁটকি মাছ এর গন্ধ যে অমল বাবু ছোট বেলায় সহ্য করতে পারতেন না, আজ তার সব চেয়ে পছন্দের রান্না, নিজের বউ এর হাতের শুঁটকি মাছ এর চাটনি। সর্শে ইলিশ বা বেগুন-কাঁচা লঙ্কা দিয়ে ইলিশ এর ঝোল পেলে তিনি আর কিচ্ছু চান না।
আর এদিকে তার নতুন বউমার হাতের রান্না ও মন্দ না। ঋতুপ্রিয়ার হাতে ডাব চিংড়ি খেয়ে তিনি তো বলেই বসেন, ” সমু, তুই যদি একে বিয়ে না করতিস, একটা বড়োসড়ো লস্ হয়ে যেত”।
কচুর সাগ দিয়ে যে অতো ভাল ভাল রান্না হত, অমল বাবুর মা তো কোনদিন বিশ্বাস-ই করতেন না যদি না তিনি অমন বউমা পেতেন। তখন তো তপতি দেবি বাড়িতে একা ইস্ট বেঙ্গল এর সাপোর্টার । আর মোহন বাগান ম্যাচ জিতলে-ই, রান্নায় বেশি বেশি করে ঝাল দিয়ে দিতেন ইচ্ছে করে, আর তারপর বাড়িতে এনে রাখা মিষ্টির হাড়ির ডাক পড়তো খুব তড়ি ঘড়ি করে। এসব গল্প শুনতে ঋতুর খুব ভাল লাগে তার শশুর মশাই এর কাছে।
শশুর-বউমার জুটি টা ততোক্ষণ ভাল, যতক্ষন না শুরু হয় সেই আদিম অকৃত্রিম গোলযোগ।
ঋতুপ্রিয়ার এই বাড়িতে আসার আগে তপতি কে একা হাতে , থুরি, একা মুখে সামলাতে হতো বাবা-ছেলের জুটি কে। আজ কাল তিনিও বড় শক্তিশালী মনে করেন নিজেকে।
তারা বলে যে ঘটি হওয়ার মধ্যে-ই আছে আসল আভিজাত্যের লক্ষণ.. তারা যে নিজের দেশেই রয়েছে..ঘটি দের আলু পোস্ত কে মারতে পারবে নাকি কচু দিয়ে চিংড়ি ? আবার চিংড়ি, সেটা ও তো এদেশী! ঠিক আছে, ঠিক আছে, তাহলে বরং এটা-ই জিগেস করি, পোস্ত কে নাহয় বেগুন ইলিশ এর মুখোমুখি রাখা গেল, কিন্তু সবুজ-মেরুন এর সামনে দাড়াতে পারবে লাল-হলুদ? আচ্ছা সেটা নিয়েও নাহয় তর্ক করলাম না, ও দেশ থেকে এসে এই দেশে বাসা বেঁধে ঘটি দের কে কেউ প্রশ্ন করে নাকি যে ‘বাঙ্গাল বড় না ঘটি’ ?
ঝাল-মিষ্টি সব মিলে মিশে গেছে এই পরিবার টায়। বউ দের ঝাল প্রীতি কে হার মানিয়েছে বাবা – ছেলে, আর প্যাকেট প্যাকেট মিষ্টি এনে ফ্রিজ ভরতি করে ঋতুপ্রিয়া। সংসারের গিন্নি মাঝে সাঝে রান্নায় মিষ্টিও দেন, তবে ঘটি-ঘটি করে লাফালাফি করেও সবাই ঝাল টাই পাতে চায় আর সব শেষে থাকে মিষ্টি ।
ঝগড়া হয়। অথচ অন্যান্য পরিবার এর মত সে ঝগড়া মান অভিমান বা, কথা কাটা কাটি কে কেন্দ্র করে হয়না। সেই ঝগড়া হাসি ঠাট্টার। সেই ঝগড়া যত না দূরে ঠেলে দেয় তার চেয়েও বেশি কাছে এনে দেয়। সেই ঝগড়ার মূলে কোন ভুল বোঝাবুঝির সুত্রপাত নেই।
আর নিজেদের পূর্বসুরি দের ফেলে আসা অতীত নিয়ে চর্চা টা বাঙ্গাল বা ঘটি-দু এই রপ্ত করে ফেলেছে রন্ধ্রে রন্ধ্রে।
ইলিশ-চিংড়ি , আলু পোস্ত-সুটকির চাটনি, তা তো গেল রান্না ঘরের ব্যাপার, আর ড্রইং রুম এর জন্য তোলা থাকে পার্টিশান আর ওদেশীদের নিজেদের ভূমি ছেড়ে আসা, ঘটি দের তাদের কে আপন করে নেওয়া, নিজেদের বাসস্তান এ জায়গা খুঁজে দেওয়া, মিলে মিশে থাকা..ওদেশীদের কে এদেশী করে তোলা..
সম্রাট ঠিক ই ভাবে পার্টিসান না হলে, আর ওদেশের মানুষ এদেশে আশ্রয় না পেলে, আজ তার মা বাবার হাত ধরে, এ পৃথিবী তে আসা হতো না, ঽতো না ঋতুপ্রিয়ার সাথে আলাপ।