জান্তব

– “না না আমি কিছুতেই স্কুল যাবনা, প্লিজ মা…” শেষ দুই সপ্তাহ ধরে বুবুনের এই বায়নাক্কা একপ্রকার নিত্যদিনের রুটিন হয়ে দাঁড়িয়েছে শিবাণীর জীবনে। “ওখানে স্যার খুব দুষ্টু, আমাকে…” কথা অসম্পূর্ণ রেখেই একপ্রকার কঁকিয়ে উঠল সাত বছরের বুবুন। রোজ স্কুল যাওয়ার নামে ছেলের এই হয়েছে নতুন এক বাহানা। অথচ আগে কিন্তু এমনটা ছিল না। এই তো কদিন আগে অবধিও স্কুলে না গেলেই বরং ছেলের মুখ ভার হত। হঠাৎ কী যে এমন হল কে জানে! দিন দুই আগে বলছিল স্কুলের অঙ্কের স্যার নাকি ওকে জোর করেই আদর করে, সেই যেমনটা ওদের ক্লাসটিচার ম্যাম ‘ব্যাড টাচ’ বলেছিলেন অনেকটা নাকি ওরকম। শিবাণী বিশেষ পাত্তা দেয়নি। এদিকে দিন দিন অঙ্কে নম্বর কমছে, আর বকলেই ছেলের এই অভিযোগ। ছেলেদের নাকি আবার ব্যাড টাচ, নাহ্, সব ঐ টিভি দেখার কুফল আর অঙ্ক না করার অজুহাত। রাগে গজরাতে থাকে শিবাণী। কই সেদিনও তো বুবুনের ক্লাসের সম্রাটের মা এর সাথে দেখা হল, কত প্রশংসাই না করল ওদের অঙ্কের স্যারের। অল্পবয়সী ভদ্রলোক খুবই মিশুকে আর বাচ্ছাদের ভালোবাসেন খুব। সম্রাট, সুহাস, তন্নিষ্ঠা, বুবুনের সব বন্ধুরাই নাকি স্যারকে খুব পছন্দ করে আর বুবুনও তো কিছুদিন আগে পর্যন্ত ভালোই ছিল। ছেলেটা ছোটো থেকেই হাতের বাইরে বেরিয়ে যাওয়ার আগে আরো বেশি করে ওকে নজরে রাখতে হবে, মনে মনে ভাবে শিবাণী।
আড়াল থেকে রোহিত সব শুনেও চুপ থাকে। ছেলের অভিযোগে কিন্তু তার মাথায় তখন অন্য চিন্তাই বেশি চলছে। তার স্ত্রী এর মত সেও কিন্তু ছেলের অভিযোগ গুলো নিতান্তই ফেলনা বা অজুহাত বলে মেনে নিতে পারছেনা, এতে তার মন সায় দিচ্ছেনা মোটেই।

দুদিন পরে টিভিতে সান্ধ্যকালীন খবরের চাঞ্চল্যকর হেডলাইন- “মধ্য কলকাতার নামী স্কুল থেকে বাচ্ছাদের যৌননিগ্রহের দায়ে গ্রেফতার অঙ্কের শিক্ষক”। শিবাণী বিস্মিত! বুবুনের স্কুলের ঘটনা তখন সমস্ত নিউজ চ্যানেল গুলোর হেডলাইন। রোহিত বোঝায় তাকে যে পিডোফিলিয়া একপ্রকার মানসিক বিকৃতি, যা কোন বয়স মানেনা, কোন লিঙ্গভেদ বোঝেনা। এই সবকিছু নির্বিশেষে কোনো বাচ্ছা দেখলেই পিডোফিলরা তাদের জান্তব দাঁত, নখ বার করে ঝাঁপিয়ে পড়ে। আবার একটা বাচ্ছাকে সে তার মানসিক বিকৃতির শিকার করছেনা মানে এই নয় যে অন্য কোনো বাচ্ছকে সে তার টার্গেট বানাবেনা। এদের অবিলম্বে চিহ্নিত করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি প্রয়োজন। নাহলে ফুলের মত নিষ্পাপ শিশুদের মনে এই ছোট্ট বয়সেই যে গভীর ক্ষত তৈরি হয়ে যেতে পারে তা হয়তো সারা জীবনেও সারবেনা। এই কারণেই বুবুনের সাথে আলাদা করে কথা বলে রোহিত যখন জানতে পারে যে বুবুনের অঙ্কের স্যার ওর প্রাইভেট পার্টসে হাত দেয়, সে আর এক মূহুর্তও দেরি না করে পুলিশের কাছে ছুটে যায়। নাহলে আজ বুবুন, কাল হয়তো অন্য কেউ। বুবুনও ভয় পেয়েছিল প্রথমে। ভেবেছিল মা এর মত বাবাও যদি তাকে বিশ্বাস না করে বকে দেয়। কিন্তু তারপর রোহিত তাকে বুঝিয়ে সুঝিয়ে সবটা জানার চেষ্টা করে। পুলিশও নিজের মত করে ইনভেস্টিগেট করে বাকি সম্পূর্ণ সত্যিটা খুঁজে বের করবে এরপর।
ছেলে কে অবিশ্বাস করার আত্মগ্লানিতে শিবাণী মরমে মরে যায় এবার, এত বড় ভুল সে কি করে করলো! মা হয়ে ছেলেকে বুঝলো না। আরও কত বড় সর্বনাশ ঘটে যেতে পারত ভেবে বুক কেঁপে ওঠে তার। রোহিত তখনও ছেলেকে আগলে রেখেছে দুহাত দিয়ে।

Facebook Comments Box

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *