মালতীলতা

কদিন ধরেই শরীরটা ভালো যাচ্ছেনা মালতীর। অবশ্য শরীরের আর দোষ কি! কম তো ধকল যায় না সারাদিন… তার উপর এই বয়সে এসেও রোজ নিদেনপক্ষে চার পাঁচটা করে খদ্দেরের ধাক্কা… দুই কুড়ি বয়েস পেরিয়েও শরীরে তার আগুন কম না তাই চাহিদা তার এখনো ভালোই তা বেশ জানে মালতী। বাবুরাও পয়সা যেমন ঢালে শরীরের খ্যাঁটন কম নয় তাদেরও। তার উপরে রোজ উঠতে বসতে লক্ষ্মী মাসির দু কথা শুনিয়ে দেওয়া বা তাকে দিয়ে একটু বেশি খাটিয়ে নেওয়া তো আছেই। কেন যে ওর ওপর এতো ঝাল লক্ষ্মী মাসির সে কি আর ও বোঝেনা! মাসির নজর তো ওর ওই কচি মেয়েটার ওপর… সেই যে গেলো বার দশ কেলাসের পাশ দিল তখন থেকে মালাকে ধান্দায় নামাবে বলে উঠে পড়ে লেগেছে… খালি খালি যে ওকে বসিয়ে খাওয়াবেনা তা মালতীও বোঝে তাই ও দুজন মানুষের কাজ করে দেয় নিত্যিদিন, তাও যেন মাসির রাগ পরে না!
মেয়েটাও দিন দিন ডাগরডোগর হয়ে উঠছে, ভয় তো মালতীও পায়, নেহাত এই মেয়ের জন্ম থেকেই পোড়া কপাল তাই এই নোংরা গলিতে এসে পড়েছে… কিন্তু মালতী যতদিন বেঁচে আছে মালাকে সে এই অন্ধকার গলিতে কিছুতেই হারিয়ে যেতে দেবেনা। বাবুদের ‘দয়া’ আর ‘ভালোবাসা’র ঠেলায় মালতীর নিজের পেটেও বাচ্চা এসেছিল বারদুয়েক। কিন্ত সেগুলোতো পেটেই নষ্ট হয়ে গেল। পোয়াতি মা কি আর রোজ ওই ভালোবাসার অত্যাচার সইতে পারে! তা যাক তাতে মালতীর মোটেও দু:খ নেই… এই নরকের কীট হওয়ার চেয়ে এই বুঝি ভালো হলো…
মালাকে সে কুড়িয়ে পায় অনেক বছর আগে। খদ্দেরের সাথে বাইরে গেছিল, সেখান থেকে ফেরার পথে আবর্জনার মধ্যে পুটুলি পাকানো একরত্তি মেয়েটাকে দেখে তুলে নিয়ে আসে। তারপর থেকে মালা রয়ে গেছে ওর কাছেই, ওর মেয়ে হয়ে। একবার কতগুলো ডাক্তার দাদা দিদি এসেছিল ওদের কিসব যেন পরীক্ষা করতে। সেখানেই এক ডাক্তার দিদি, নাম ছিল মালবিকা, ভারী মিষ্টি মেয়ে, কত ভালো করে কথা বলছিল ওদের মতো মানুষদের সাথেও, ভারি ভালো লেগেছিল মালতীর। তাই মেয়ের নাম রেখেছে ওই ডাক্তার দিদির নামেই… মালবিকা… তার আদরের মালা। মেয়েকে পড়তে পাঠিয়েছে সরকারি ইস্কুলে, ও মেয়েকে আরো পড়াবে, মেয়ে আরো পাশ দেবে তারপর সে মালতীকে নিয়ে চলে যাবে এখান থেকে অনেক দূরে, ওই বাবুদের সমাজে। সেখানে তারা মা-মেয়ে মাথা উঁচু করে বাঁচবে, এখনো স্বপ্ন দেখে মালতী। এই অন্ধকারেও সে স্বপ্ন দেখতে ভোলেনি…
মালবিকা আজ এক নামকরা কাগজের সাংবাদিক।পাশাপাশি একটা এনজিও চালায় সে যারা কাজ করে তার মতো তথাকথিত সমাজের পিছিয়ে পড়া যৌনকর্মীদের সন্তানদের নিয়ে। মালতীর স্বপ্ন পূরণ হয়েছে। পথটা সহজ ছিলনা মোটেই। ঐ জগতে থেকেও মেয়েকে এতদূর পড়ানো, তাকে ভদ্র সমাজের যোগ্য করে তোলা বা একটা অন্ধকার জীবন থেকে বেড়িয়ে এসে আলোর পথ ধরা, কিন্ত একজন মা তার সন্তানের জন্য সব পারে। বেঁচে থাকুক এরকম হাজারো মালতী, মালবিকারা মাথা উঁচু করে সম্মানের সাথে… সমাজে ঘটুক এক নবজাগরণ।
Facebook Comments Box

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *