রোজার রথ

গত দুদিনের মত সেদিনের বিকেলটাও বৃষ্টিতে ধুয়ে আরও কিছুটা স্বচ্ছ হয়ে মানুষের উৎসব মেতে উঠেছিল । ভেজা ফুটপাথে কত কত মুখ দ্রুত সরে যাচ্ছিল । গাছতলায় দাড়িয়ে ভিড় দেখছিল আফরিন । প্রতিটা মানুষ , প্রতিটা মুখ একটা নতুন গল্প বলে । মানুষের গল্প পড়তে মেতে ছিল আফরিন ; সম্বিত ফিরল মাসুদের ডাকে…
– কি রে কি দেখছিলি ?
– কিছু না । চল ।

ক্লাস টুয়েলভের আফরিন আর ওঁর থেকে বছর তিনেকের বড় মাসুদ । দুজনের প্রেমের প্রায় এক বছর হল । মাসুদ বরাবরই সিরিয়াস গোছের ছেলে আর আফরিন ঠিক তার উল্টো । সারাদিন দুজনের খুনসুটি লেগেই থাকে । আজ বেরোনোর পর থেকেই আফরিনের একের পর এক বায়না । এই আইসক্রিম খাবে তো পরক্ষনেই ফুচকা । মাসুদ বারণ করে কিন্তু কে কার কথা শুনবে ! আফরিনের জেদ কাছে ওকে প্রতিবারই স্তব্ধ করে দেয় । আর না হলে আফরিনের সেই বিখ্যাত নীরব অথচ তীব্র কান্না তো আছেই ।
– ঐ দ্যাখ রথ । কি সুন্দর !
– হ্যাঁ খুব সুন্দর করে সাজায় ওরা ।
– সবাই কি আনন্দ করে রথের দড়ি টানছে । কি ভাল !
– হুম । নে চল এবার । কোথাও গিয়ে বসি ; রোজার দিনে বেশি হাঁটা যায়না ।
– এই শোন’না ……
– বলে ফেলো সোনা ……
– চল আমরাও রথের দড়িটা টানি , খুব ইচ্ছে করছে আমার ।
– তুই পাগল , আফরিন । আমরা মুসলমান । আমাদের ওখানে যাওয়া বারণ । ওটা হিন্দুদের অনুষ্ঠান ।
– না না… আমি যাবই । চল’না রে , এমন কেন করিস !
– তোর মাথা খারাপ হয়ে গিয়েছে ; ঝামেলা করিস না আফরিন । চল এখান থেকে ।
– আমি ঝামেলা করি ? ভাল , আমি চললাম দড়ি টানতে । তুই ইচ্ছে হলে আসবি , নয়তো আসিস না ।
– আফরিন………… হে আল্লাহ্ , এই মেয়েটার কি হবে !

ততক্ষণে আফরিন রাস্তা পেরিয়ে রথের দিকে যেতে শুরু করেছে । আরও একবার আফরিনের জেদের কাছে হেরে গিয়ে মাসুদ বাধ্য হয়েই ওর পেছন পেছন গেল । ভেতর ভেতর কেমন যেন ভয় করতে লাগলো । “ কেউ যদি দেখে ফেলে ’’ , “ ওরা যদি জেনে যায় যে আফরিন মুসলিম ’’ এরকম অনেক প্রশ্ন মাসুদের মাথায় আসছিল কিন্তু কোন উত্তর ছিল না ।
আফরিন ভিড় পেরিয়ে গিয়ে রথের রশি ধরেছে । বাকিদের সাথে ও টানছে দড়িটাকে । তখন আফরিনের খুশির অন্ত নেই । চিৎকার করে বলল , “ এই মাসু , তুইও আয় । দ্যাখ কি মজা । ’’ মাসুদ ওর পাশে গিয়ে দাঁড়াল । আফরিনের আনন্দ দেখে মাসুদও খুব খুশি । কিন্তু একটা ভয় ওর ভেতরে তখনও বিদ্যমান । ঠিক তখনই আফরিনের ফোনটা বেজে উঠল । এক হাতে দড়িটা ধরে রেখেই আরেক হাতে আফরিন ফোনটা রিসিভ করল ………..

– হ্যালো ! বল আম্মি ।
– তোমার যা ইচ্ছে রান্না কর না ।
– না না , আজ আর মাংস কোরো না । কাল ঈদে বিরিয়ানি খাবই তো । তুমি বরং একটু পুডিং বানিয়ে রাখ ।
– আচ্ছা এখন রাখি ।
– হ্যা তাড়াতাড়িই বাড়ি ফিরব গো ।
– আল্লা হাফিজ !

.

মুহূর্তের নিস্তব্ধতা । আশেপাশের প্রতিটা মানুষ আফরিনের দিকে তাকিয়ে । মাসুদের মুখটা কালো করে এসেছে । আফরিন কিছু বুঝে ওঠার আগেই তিলক পড়া এক ভদ্রলোক এসে বললেন , “ এই মেয়ে , তুই মুসলমান ? ’’ আফরিন মুখটা তখন ফ্যাকাশে । “ কিরে কিছু জিজ্ঞেস করছি তো । উত্তর দে । ’’ আধ আধ স্বরে আফরিন বলল , ‘ হ্যা ’ । “ এখানে কি করছিস তুই ? ’’ আফরিনের মুখে কোন কথা নেই । চোখের কোণ থেকে এক জোড়া অশ্রুর রেখা থুতনির কাছে এসে মিশেছে । মাসুদ ছুটে এসে বলল , “ ওকে মাফ করে দিন । ও বোঝেনা কিছু । আর হবে না কোনোদিন , ছেড়ে দিন আমাদের ।’’ লোকটা তেড়ে এসে বলল , “ এত বড় ঢ্যামনা মেয়ে , বোঝেনা মারাতে এসেছ ।’’ মাসুদের চিবুক শক্ত , “ বাজে কথা বলবেন না আঙ্কেল ’’ ………… লোকটা কিছু বলার আগেই উত্তেজিত জনতার মধ্যে থেকে ভেসে আসছে ,
– শালা মুসলমান গুলো এমনই হারামি হয় ।
– সব টেররিষ্টের বাচ্চা । কি মতলব নিয়ে এসেছিল কে জানে ।
– পবিত্র অনুষ্ঠানটাকে বিষিয়ে দিল কাটার বাচ্চাগুলো । মার শালা এদের ।

ভিড় থেকে একজন এসে মাসুদের বুকে ধাক্কা দিল একজন । মাসুদ রাস্তার ওপর পড়ে গেল । আফরিন দৌড়ে গেল মাসুদের কাছে । মাসুদের কপাল থেকে রক্ত পড়ছে , আফরিন কেঁদে চলেছে চিৎকার করে । আরেকজন এসে আফরিনের পিঠে একটা লাথি দিতে আসছিল , কিন্তু সামনে কাকে একটা দেখতেই পিছিয়ে এলো দু’পা । গেরুয়া ধুতি পরিহিত , কপালে চন্দনের টিপ পড়া প্রায় ছ’ফুট লম্বা ধবধবে ফরসা লোকটা সামনে এসে দাড়াতেই ভিড়টা হঠাৎ নীরব হয়ে গেল । চারিদিকের নিস্তব্ধতা ভেঙ্গে দিয়ে গেরুয়া বসন বলল , “ আয় মা উঠে আয় ।’’ তারপর নিজে গিয়ে মাসুদ আর আফরিনকে তুলল , “ কিভাবে মেরেছে এরা ! ’’ পাশ থেকে একজন বলল , “ স্বামীজি , আপনি জানেন এরা কারা ? কি করেছে এরা ? ’’
“ আমি সব জানি রে বাছা । সব দেখেছি । একটা কথা বলত , ধর্ম তোদের মারতে শিখিয়েছে ? তোরা আবার নিজেকে হিন্দু বলিস ? লজ্জা করেনা তোদের ? তোরা এই মানসিকতা নিয়ে জগন্নাথের সাধনা করবি ? ওরে , এই উৎসব মানুষের উৎসব । এখানে হিন্দু মুসলমান নেই । জগন্নাথ হিন্দুকে চেনেনা , মুসলমানকে চেনেনা , মানুষকে চেনে । স্বয়ং জগন্নাথের সামনে তোরা পাপ করেছিস । এই পাপের প্রায়শ্চিত্ত করবি কিভাবে ! ………… আয় মা আয় তোরা ………… ’’

ভিড়ের প্রতিটা মুখ তখন লজ্জায় নিচু । গেরুয়াধারি তখন মাসুদ আর আফরিনের হাত ধরে প্রকাশ্য রাজপথে বীরদর্পে এগিয়ে চলেছে । আফরিনের চোখের জল মুছে , ওর সঙ্গে রথের ওপরে উঠল । ‘ জয় জগন্নাথ ’ স্বরে আবার চলতে শুরু করল রথ । ছলছলে চোখে আফরিনের ঠোঁটে আবার হাসি ফুটল । রথের ওপর থেকে ও লাখ লাখ সাদাকালো মাথা দেখছিল । চারিদিকের প্রতিটা চোখ তখন ওর দিকে তাকিয়ে । মাসুদ তখন আকাশের দিকে মুখ করে হাঁটু ভেঙ্গে রাস্তার ওপর বসে আল্লাহ্‌কে ডাকতে লাগলো । চোখের সামনে ভেসে উঠল গেরুয়াবসনার উজ্বল মুখটা । মাসুদ চিৎকার করে বলল , ‘ ফেরেশতা ’

Facebook Comments Box

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *