পুরুষরাও ধর্ষিত হয়, তাই তো?

ভাবা যায়না না! সমাজের প্রধান স্তম্ভ, সংসারের দৃঢ় ঢাল, রণভুমির প্রধান যোদ্ধা যে পুরুষেরা সেই পুরুষরাও ধর্ষিত হয়। দিল্লি থেকে কামদুনি, পার্কস্ট্রিট থেকে সিঙ্গুর অথবা সোনাগাছির অলিতে-গলিতে যাদের বেপরোয়া লাম্পট্য সভ্যসমাজের গায়ে কলঙ্কের ছাপ এঁকে দিয়েছে সেই পুরুষরাও ধর্ষিত হয়। নাহ্, দিনে দুপুরে অলীক গল্প শোনাতে আসিনি আমি।এসেছি চোখে ঠুলি পড়ে থাকা সবকিছু দেখেও না দেখা, এই গতানুগতিক সমাজের চোখের সামনে কিছু অপ্রিয় সত্য তুলে ধরার জন্য। অপ্রিয় বললাম তার কারণ নিজে নারীবাদী হয়েও পুরুষদের হয়ে আজ গলা তুলছি, আসল কথা কি জানেন মানুষের আগে মানুষ হওয়া উচিত তারপর না হয় নারীবাদী বা সাম্যবাদী হওয়া যাবে। সেই মানুষ হিসাবেই একদিন যেমন পণ না দিতে পেরে শ্বশুরবাড়ি আসা নববধূকে আগুনে পুড়তে দেখে প্রতিবাদে রাস্তায় মিছিল করেছি, মদ্যপ স্বামীর হাতে মার খেয়ে অসহায় স্ত্রীকে শিশুকন্যাসহ আত্মহত্যা করতে দেখে পুলিশের দ্বারস্থ হয়েছি, বা প্রেমের জালে ফাঁসিয়ে তরুণী প্রেমিকাকে নিষিদ্ধপল্লীর অন্ধগলিতে বিক্রি হতে দেখে তাকে উদ্ধার করেছি তেমনি আজ নিরপরাধ কোনো পুরুষের উপর অত্যাচারের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর মত সাহস আমি সঞ্চয় করেছি। কারণ হ্যাঁ, আপনারা মানুন বা না মানুন, পুরুষরাও ধর্ষিত হয়।

কেমব্রিজ ডিকশনারি রেইপ শব্দের অর্থ ব্যাখ্যায় বলছে, অনিচ্ছুক হওয়ার পরও কাউকে (someone) নিপীড়ন-নির্যাতনের মাধ্যমে যৌন সম্পর্কে বাধ্য করা। ইংরেজিতে পুরুষকে ‘হি’ আর নারীকে ‘শি’ বলা হলেও রেইপ শব্দটি নারী বা পুরুষের জন্য আলাদা করে নেই। ‘রেইপ ভিকটিম’ ব্যবহার করা হয় যিনি ধর্ষণের শিকার হচ্ছেন তার জন্য, রেপিস্ট  ব্যবহার করা হয় যিনি ধর্ষক তার জন্য। সুতরাং ধর্ষণের অর্থ কোনোভাবেই শুধুমাত্র নারীর সতীত্ব নষ্ট হওয়া নয়। নারীকেই ধর্ষণ করা যায় এ কথা প্রতিষ্ঠা করে ধর্ষকামী মানসিকতাকেও আশকারা দেওয়া যাবে না।কারন পুরুষরাও ধর্ষিত হয় আর এর প্রমান অতীতেও অনেক আছে। মিরপুর শেওড়াপাড়ার মাদ্রাসা থেকে কেরানীগঞ্জের মাদ্রাসার ছেলেশিশু; দিনাজপুরের বীরগঞ্জের মাদ্রাসা হোক অথবা ঢাকার মোহাম্মদপুরের মাদ্রাসার কিশোর; এদের সঙ্গেও প্রতিনিয়ত ঘটছে যৌন অত্যাচার। ঘটছে যৌন হয়রানি সংশ্লিষ্ট আত্মহত্যা ও হত্যার ঘটনাও।

প্রাচীন বাংলা অভিধানে আবার অনিচ্ছাকৃত যৌনমিলন ছাড়াও ধর্ষণের অর্থ হিসেবে উৎপীড়ন বা নিপীড়নকে নির্দেশ করেছে। সেই হিসেবে দেখতে গেলে সমাজের বহু ক্ষেত্রে বহু পুরুষ প্রভাবশালী ব্যক্তির দ্বারা প্রতি মুহূর্তে ধর্ষিত হয়ে চলেছে। সে চাকুরীজীবী সাধারণ কেরানির তার মালকিনের দ্বারাই হোক বা অভাবী,মেধাবী,বেকার যুবকের অর্থের লোভে বিত্তশালী কারোর মনোরঞ্জন করাই হোক আসলে কিন্তু জ্ঞানে- অজ্ঞানে,অভাবে- স্বভাবে, বা পরিস্থিতির চাপে পড়ে পুরুষরাও ধর্ষিত হয়। কিন্তু আশ্চর্যের ব্যাপার হলো এই সাধারণ সত্যি কথাটা, সাধারণ ভাবে মেনে নেওয়ার সাহস, সাধারণ মানুষের থাকে না। সেই কারণেই হয়তো ভারতীয় সংবিধানের কোনো ধারা বা মানসিক দিক থেকে বিপর্যস্ত ধর্ষিত কোন পুরুষের চোখের জল কোন কিছুই এটা স্বীকার করাতে পারে না যে পুরুষরাও ধর্ষিত হয়।

কোন একটি বিদেশি ম্যাগাজিনে কিছু বছর আগে পড়েছিলাম বিদেশে প্রভাবশালী মহিলারা নিজেদের মনোরঞ্জন বা যৌন পরিতৃপ্তির জন্য বলবান অল্প বয়সি পুরুষদের টাকা দিয়ে নির্দিষ্ট সময়ের জন্য ভাড়া করে নিয়ে যায়। এবং ওই নির্দিষ্ট সময়কালে ওই পুরুষটি মহিলাটির কাছে ক্রীতদাসের ন্যায় বাধ্য থাকবে ,শুধু তাই নয় যৌন উত্তেজনাকালে জুতোর ঘা ই হোক বা সিগারেটের ছ্যাঁকা, সমস্ত অত্যাচারই মুখ বুজে সহ্য করবে। অর্থ্যাৎ ধর্ষণ জেন্ডার সংবেদনশীল হতে পারে না। একজন ব্যক্তি  মর্জির বাইরে গিয়ে, ধোঁকা দিয়ে অথবা নির্যাতন করে অপর ব্যক্তির সঙ্গে যে শারীরিক প্রক্রিয়াতেই যৌন সম্পর্ক করে থাকুক, সেটাকে ধর্ষণ বলতে দ্বিধা করা যাবে না। এখানে ব্যক্তি মানে নারী অথবা পুরুষ অথবা হিজড়া– যে কেউ হতে পারে।

অবশ্য, এখন যৌন হয়রানি যে শুধু নারীকেই করা যায় এমন ধারণা থেকে বেরিয়ে আসার প্রক্রিয়ায় রয়েছে ভারত। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে যৌন হয়রানির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া নিশ্চিত করতে  ২০১৬ সালে ভারতের বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের দেওয়া নির্দেশনায় স্পষ্ট করে বলা হয়েছিল, যৌন হয়রানি জেন্ডার নিরপেক্ষ (sexual harassment is gender neutral)। তাই শিক্ষার্থী যে লিঙ্গেরই (all sexes) হোক না কেন, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে তার অভিযোগ যথেষ্ট আমল দিয়ে উপযুক্ত ব্যবস্থা নিতে হবে।গুড টাচ, ব্যাড টাচের পার্থক্য শুধুমাত্র স্কুলে ভর্ত্তির আগে আপনার আদরের শিশুকন্যাটিকেই নয় বরং শিশুপুত্রটিকেও শেখান কারণ আবারো বলছি, পুরুষরাও ধর্ষিত হয় এ বিষয়ে উপযুক্ত প্রমাণ আজ সবাই পেয়ে গেছে।

Facebook Comments Box

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *