আজ শহর জুড়ে বর্ষা নেমেছে। জুলাই মাসের শেষ সপ্তাহে শ্রাবন ঘনিয়েছে আমার শহরে।
তুমুল বৃষ্টি পড়ছে সেই শেষবিকেল থেকে। এখন জলের বেগ ধরে এসেছে। আমি দাঁড়িয়ে আছি ১২তলায় আমার ফ্ল্যাটের ব্যালকনিতে… ঝাপসা হয়ে যাওয়া একটা শহরকে দেখছি উঁচু থেকে… রাস্তায়, বাড়ির ছাদে, স্কাইক্র্যাপারে সর্বত্র লেগে রয়েছে জলছাপ! জানালার কাঁচে গড়িয়ে পড়ছে জল… যেন ধুয়ে দিচ্ছে শহরটাকে। নিয়ন আলোয় মায়াবী লাগছে সবকিছুই। আমিও কফিমগ হাতে নিয়ে উপভোগ করছি এমন একটা সন্ধ্যা। কবিতার বই নিয়ে বসে পরা যেত এমন সময়ে… বাইরের ঝিরিঝিরি বৃষ্টির শব্দ যেন আরও কাব্যময় করে তুলতো পরিবেশটাকে। কিন্তু এমন দিনে রূপম বাইরে… আমি এখানে একা। আজ বোধহয় আড়ম্বর করে তোমাকে মনে করা যায়! সাউন্ড সিস্টেমে প্রিয় গান চালিয়ে দিলাম… দেবদীপ গেয়ে চলেছে, “যদি পারো প্রিয় বন্ধুকে দিও এসো প্রিয় গান, তার উড়োজাহাজের পায়ে বেঁধে দিও কালবৈশাখী…” শুনতে শুনতে আমিও ঘোরের মধ্যে অতীতের দিনে ফিরে যাচ্ছি। আজকাল অতীত আর যখন তখন সামনে এসে দাঁড়ায়না। আমার শহরে বর্ষা আসেনা সেভাবে। মাঝেমধ্যে অতীতকে আমন্ত্রণ জানালে সে আসে… বিরহ ছড়িয়ে দিয়ে যায়। বিরহের একটা সুগন্ধ আছে যা আমাকে মাতাল করে রাখে। হঠাৎ মনে হল লেখা পাচ্ছে ভীষণ… খাওয়া, ঘুমের মতোই লেখাও আসলে কখন যে ভীষণভাবে বেরিয়ে আসতে ব্যাকুল হয় তা অন্যরা বুঝবেনা। তাই লিখতে বসলাম। একটা চিঠি লিখবো ভাবলাম…
প্রিয় বন্ধু,
কেমন আছো তুমি?? মেঘদূত আমাকে আর তোমার খবর পাঠায়না আজকাল… আমিও আর বৃষ্টি নামাইনা আমার দুই চোখে… আজকের এই চিঠিও তোমার ডাকবাক্সে পৌঁছাবেনা তাই প্রশ্ন না করে বরং আমার কথা লিখি।
আজকাল তোমায় যখন তখন মনে পরেনা, কখনো সখনো মনে পরে। আবার কোনোদিন আমি আড়ম্বর করে তোমার কথা মনে করি। আজ তেমনি একটা দিন। আমার বর রূপম আজ অফিসের কাজে বাইরে গেছে দুদিনের জন্য আর শহরে বর্ষা এসেছে… তাই আজকের ঝিমধরা সন্ধ্যেটা নষ্ট করলামনা। এক পশলা স্মৃতি উস্কে দিচ্ছে আমায়… মনে পরে যাচ্ছে এমনি একটা বর্ষার সন্ধ্যায় আজ থেকে বছর সাতেক আগে তোমার সাথে বকবক করে তোমার ভিডিও গেম খেলা পন্ড করে দিয়েছিলাম আমি! তোমার বাড়িতে সেদিন খিচুড়ি হচ্ছিলো আর তার সুবাসের কথা তুমিই ফোনের ওপার থেকে বলেছিলে আমাকে। তাও জানো অনেক ফিকে হয়ে গেছো তুমি ঐ বৃষ্টিতে দূরের স্ট্রিটলাইটের মতোই… আর আমি হয়তো পুরোপুরি মুছে গেছি তোমার স্মৃতি থেকে ঐ বর্ষা ধুয়ে দেওয়ার পরে রাস্তায় যেমন একবিন্দু ধূলো জমে থাকেনা তেমনি। আমি অভিযোগ করছিনা, বাস্তবটা বলছি। এই চিঠি রূপম যদি দেখে ভাববে এটাও আমার কোনো একটা সৃষ্টি!
শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের একটা বৃষ্টির কবিতা মনে পড়ছে জানো… “বৃষ্টি নামল যখন আমি উঠোন-পানে একা, / দৌড়ে গিয়ে ভেবেছিলাম তোমার পাবো দেখা। … কিন্তু তুমি নেই বাহিরে – অন্তরে মেঘ করে / ভারি ব্যাপক বৃষ্টি আমার বুকের মধ্যে ঝরে!” কি? কেমন লাগলো? জানি, বলবে এই কবিতা সবার মনে দাগ কাটে।
কি বলছো? আমার লেখা কবিতা কই? বেশ, এই চিঠির শেষে আমার লেখা একটা বৃষ্টির কবিতা নাহয় পাঠাবো তোমাকে। জানিনা সেটা কবিতা হবে কিনা! তুমি জানো তোমাকে না বলতে পারা কথাগুলোই আমাকে প্রতিনিয়ত তাড়িয়ে বেড়াতো… তারপর নিজেকে শান্ত করতে বুকের ভিতরে জমে থাকা কথার পাহাড় উগরে দিয়েছিলাম সাদা পাতাতে, অদ্ভূত এক মুক্তি মিলেছিল লিখে ফেলার পরে। অনুভূতি কখন শব্দ হয়ে ধরা দিলো বুঝিনি।
এই চিঠি লেখার মাঝে উঠেছিলাম একবার। রূপম ফোন করে খোঁজ নিচ্ছিলো তার বৌয়ের। এক কাপ ধোঁয়া ওঠা কফি নিয়ে ব্যালকনিতে বসলাম আবার বর্ষা উদযাপন করতে। বৃষ্টির ছাট নেই। আচ্ছা, আমার হাতেগোনা কয়েকটা বই প্রকাশিত হয়েছে, একটাও পড়েছো তুমি? আমার লেখা বোধহয় তোমার ভালো লাগবেনা! তুমি এখনো প্রিয়াঙ্কা চোপড়ার সিনেমা দেখো? আগে তো ভীষণ পছন্দ করতে! আসলে তুমি তো শুধু একটা ‘তুমি’ নও, তোমার সাথে জড়িয়ে আছে অজস্র মুহূর্ত, বেশ খানিকটা সময়, অনেকগুলো স্মৃতি। তুমি আসলে লেগেছিলে ক্যালেন্ডারের অনেকগুলো তারিখে, তুমি জড়িয়ে ছিলে বেশকিছু অন্য মানুষের নামের সাথে, তুমি লেগে আছো বেশ কিছু গানের লাইনে, তুমি জড়িয়ে থাকবে কয়েকটা কবিতার গায়ে। তুমি আসলে একা একটা মানুষ ছিলেনা কোনোদিনই… অন্য অনেককিছুর জন্যও তোমার কথা মনে পড়বে। এসব আমি জানতাম। তুমি হয়তো মানবেনা, বলবে, এই অসীম পৃথিবীর কতটুকু জায়গায় তোমার অস্তিত্ব? হয়তো বলবে এতবড়ো জীবনকালে কটা বর্ষা আমরা কাটিয়েছি একসাথে তাই যে তোমাকে ভোলা যাবেনা কিছুতেই? হয়তো কথাটা খুব একটা ভুল নয় কারণ এখন রূপম এসে ভাগ বসিয়েছে ক্যালেন্ডারের বেশ কিছু তারিখে যেগুলোর গায়ে সে লেগে আছে, সেও লেগে গেছে অনেকগুলো গানের সাথে কিংবা কিছু কবিতাতেও। তোমার সাথে যতগুলো দিনরাত্রি মনে মনে যাপন করেছি বাস্তবে ওর সাথে সংসার করছি তার থেকে আরও কটাদিন বেশী। আজ থেকে বছর ছয়েক আগের এক বর্ষা আমাকে শিখিয়েছে মেনে নিতে। আর তখনি মনে হল বন্ধুবিচ্ছেদ তো আগেও কতবার হয়েছে… মাধ্যমিকের পরে যখন স্কুল বদলানো হল, তারপর উচ্চ মাধ্যমিক দিয়ে, আবার কলেজ শেষে, আরও কতবার কতভাবে… প্রতিবার হারিয়েছি কিছু বন্ধুকে। প্রতিবারই কষ্ট পেয়েছি তো… মনখারাপ হয়েছে… তাহলে এবারও সামলে নেবো ঠিক।
বর্ষা খুব রোমান্টিক লাগে আমার। বলবে রোমান্স করে পেটের ভাত জোগাড় হয় বিয়াস? হয়তো বলে বসবে রূপমের মতো একটা বর থাকলে যে কেউ এই জানালার কাঁচ বৃষ্টির জলে আবছা হয়েছে দেখে কাব্যি করতে পারে! ঠিকই বলেছো, বিয়াস মিত্র কিচ্ছু পারেনা রূপমকে ছাড়া। রূপম সেই মানুষ যে আমার পাগলামীগুলোকে প্রশ্রয় দেয়, রাতের শহরে গঙ্গার ধারে হাওয়া খাওয়ার সঙ্গী হয় সারাদিনের পরিশ্রমের পরেও। আমি জানি তোমার জীবনেও এমন কেউ আছে যে আমার মতো হাবিজাবি বকেনা। আর বেশি কথা না বাড়িয়ে আমার লেখা একটা কবিতার মতো কিছু একটা লিখে চিঠিটা শেষ করছি…
তোমার জন্য বৃষ্টিমাখা সন্ধ্যা দিন!
আমার চিঠি নিয়ে যাবে আলাদিন…
বুকের ভিতরে বৃষ্টি নামে ঝমঝমিয়ে
তোমারও কি চোখের কোলে মেঘ জমে?
কালো মেঘে ঝাপসা যেন ধূসর দিন
মেঘলা দিনে মনটা কেমন সঙ্গীহীন!
বর্ষা ঘনাক আকাশ জুড়ে রাত্রি ভোর
মনখারাপরা পথের বাঁকে সঙ্গী মোর…
ইতি,
বিয়াস।
ভোরে ঘুম ভাঙলো যখন, বৃষ্টি থেমে গেছে। প্রিয় ব্যালকনি থেকে উঁকি মেরে দেখি রাস্তায় জল জমেছে, কিছু বাচ্ছা রঙিন কাগজের নৌকা ভাসাচ্ছে। কাল অমন আমেজে কি যে কবিতা লিখলাম তা জানিনা! আমিও বহু বছর পরে ওই চিঠিটাই ভাঁজ করে নৌকা বানালাম, মনটা আনন্দে নেচে উঠলো। নেমে গেলাম লিফট বেয়ে নিচে, ভাসিয়ে দিলাম আদরের নৌকা এই মরশুমে। বর্ষা আমায় বিরহ দিলো নাকি ছেলেবেলা ফিরিয়ে দিলো জানিনা!