ভালোবাসার রঙ বলে কি আদৌ কিছু হয়? পাকা চুলের বৃদ্ধের কাছে ভালোবাসার রঙ সাদা, সদ্য প্রেমে পড়া যুবতীর রঙিন দুনিয়াতে ভালোবাসার রঙ লাল আবার হৃদয় ভাঙা তরুণ বা তরুণীর কাছে তা ফ্যাকাশে মনেহয়। কলেজে পড়া মেয়ে রাইয়ের জীবনে ভালোবাসার রঙ কিভাবে উজ্জ্বল হয়ে উঠলো সেটা নিয়েই এই গল্প।
পাড়ার গির্জায় সকাল নয়টার ঘন্টা বাজতেই রাইয়ের ঘুমটা ভাঙলো। ঘুম ভেঙেই মনে পড়লো আজকে তো কলেজ যাবে না।কাল অনেক রাত অবধি সৃতমের সাথে ঝগড়া চলেছে, স্বভাবতই ঘুমটাও ভালো হয়নি রাতে রাইয়ের। মোবাইলটা খুলতেই ওয়াল পেপারে দুজনের হাস্যরত ছবিটা দেখেই রাইয়ের মেজাজটা আরো গরম হয়ে গেল।ধুর ধুর, এসব প্রেম ভালোবাসা ব্যাপারটাই ফালতু।যদিও রাই আর সৃতমের সম্পর্কটা এখনো বিশাল সিরিয়াস, “তোমায় ছাড়া আমি মরেই যাবো” এরকম পর্যায়ে পৌঁছায়নি।
“ভালো হয়েছে। কালকেই দেখা করে ব্রেক আপ করে দেব।যেই ছেলে ভ্যালেন্টাইনস ডে তে গার্লফ্রেন্ড কে নিয়ে একটা নামি রেস্টুরেন্টে লাঞ্চ করতে নিয়ে যেতে পারেনা তার সাথে ফিউচার কি এগোবে!হুহ!” নিজের মনে মনেই কথাগুলো এক নিঃশ্বাসে বললো রাই। সৃতম রাইয়ের কলেজেই থার্ড ইয়ারের স্টুডেন্ট, রাইয়ের ফার্স্ট ইয়ার। প্রথমে সিনিয়র দাদা জুনিয়র বোনের মতো সম্পর্কটা শুরু হলেও জল যেমন উঁচু থেকে নিচের দিকে প্রবাহিত হয়, সেভাবেও সম্পর্কটা প্রেমের পর্যায়ে পৌঁছেছে।
এমন নয় যে রাই খুব বেশি ডিমান্ডিং বা বয়ফ্রেন্ড এর টাকায় ফুর্তি করতে ভালোবাসে সেরকম,কিন্তু বছরের এক অধটা স্পেশাল ডে তে স্পেশাল ফিল করতে কে না চায়, তার ওপর সম্পর্ক যখন নতুন। তার ওপর রাইয়ের ক্লাসমেট গুলো যেমন, চয়নিকা, এশা, মৃনাল নিজেদের বয়ফ্রেন্ড কে নিয়ে বড়াই করে করে মাথার পোকাগুলো অবধি মেরে ফেলবে, সেখানে তারা যদি ঘুমাক্ষরে টের পায় সৃতম রাইকে নিয়ে মোক্যাম্বোর বদলে অনামি রেস্টুরেন্টে গেছে রাইয়ের প্রেস্টিজে কেরোসিন হয়ে যাবে না!
যাক, ঘুম চোখেই রাই ঘর থেকে বেরোতেই দেখে ঠাম্মু দাদাইয়ের ফটোটা পরিস্কার করতে করতে বলছে, ” আজকের দিনে প্রথম আমায় দেখতে এসেছিলে তুমি, মনে আছে?” একটু পরেই মুচকি হেসে আবার বলে, “হুহ, বেঁচে থাকতেই বিয়ের তারিখ, ছেলে মেয়ের জন্মের তারিখ ভুলে যেতে আর এখন।” রাই একটু বিরক্ত হয়েই বলে ওঠে, “ঠাম্মু, প্রতিদিন দাদাইয়ের ফটোর দিকে চেয়ে কথা বলতে কি ভালোলাগে বলো তো তোমার!এমন করে বলো যেন দাদাই উত্তর দেবে,হুহ!”
“উত্তর না দিক দিদিভাই, তবুও মনেহয় মানুষটা সাথেই রয়েছে, কাছেই রয়েছে।” ঠাম্মুর চোখে যেন আমোঘ ভালোবাসার ঝিলিক স্পষ্ট দেখতে পায় রাই। অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করে, ” যেই মানুষটা আজ পাঁচ বছর হয়ে গেল নেই, তবুও প্রতি মুহূর্তে, প্রতি ক্ষণে মনে রাখা কিকরে সম্ভব? তোমার ক্লান্ত লাগেনা?” বছর সত্তরের বৃদ্ধার ঠোঁটে তখন হাসির দমকা বাতাস খেলে যায় যেন। সে বলে ওঠে, “হাহাহা, সে কথা তুমিও বুঝবে দিদিভাই যেদিন তুমিও সত্যি ভালোবাসবে মন থেকে।ভালোবাসার রঙে যেদিন তোমার মন রঙিন হবে সেদিন বুঝবে।”
রাই আর কথা না বাড়িয়ে খাওয়ার টেবিলের কাছে আসতেই দেখে এক পরিচিত দৃশ্য দেখতে পেলো। মা রাতের খাবার গুলো গুটিয়ে রাখছে।রাই জিজ্ঞেস করলো, “মা, বাপি কি কাল রাতেও ফেরেনি?” রাইয়ের মা বিনীতা টেবিল থেকে ভাতের বাটিটা সরাতে সরাতে বললো, “না রে, কাল সারারাত তোর বাপি বাঁকুড়ার কাছে টিমের সাথেই আটকে ছিল।আমি অপেক্ষা করছিলাম খাবার নিয়ে,শেষে যখন জানালো…!” “যখন জানালো তুমিও শুধু জল খেয়ে শুয়ে পড়লে তাই তো?” মায়ের কথা শেষ হওয়ার আগেই রাই বলে উঠলো কথা টা, কারণ সে জানে আদি অনন্তকাল ধরে এটাই হয়ে এসেছে।রাইয়ের বাপি ট্রাভেল বিজনেসের সাথে যুক্ত, তাই ঘরে ফেরার কোনো সঠিক সময় থাকেনা, আর মা এরকমই অপেক্ষ করতে থাকে।”আরে না না, ও কিছু না, আমার অভ্যেস আছে।তাছাড়া তোর বাপি খায়নি,আমার গলা দিয়ে নামবে?” রাই একটু হেসে বলে ওঠে, “আসল কথাটা বললে তবে, আর তোমাকেই বা কি বলি, তুমি উপোস করলে বাপিও এক দানা মুখে দেয়না। উফঃ তোমরা পারো বটে।” বিনীতা মেয়ের কথায় একটু লজ্জা পেয়ে বলে, “তুইও পারবি যখন তোর বাপির মতো কাউকে খুঁজে পাবি।এটাই তো ভালোবাসার রঙ,একবার রাঙিয়ে দিলে আর নিস্তার নেই।”
বিনীতা আদুরে মেয়ের গালটা নেড়ে দিয়ে দিলো। রান্নার মেয়ে লক্ষ্মী তখন কুটনো কুটছিল, সে ঠাট্টার সুরে বললো, “এসব শিখিয়ে দিতে হবেনা বৌদি, নিজেই শিখে যাবে ক্ষণ।” বিনীতা হেসে বললো, “সে যা বলেছিস।শোন, যাবার সময় ভাত তরকারি গুলো নিয়ে যাস।ঘরে গিয়ে আর কখন রান্না করবি।”রাই দেখলো লক্ষ্মীর মুখে একটা দিগন্ত বিস্তৃত হাসি ছড়িয়ে পড়লো যেন এক লহমায়।সে তাড়াতাড়ি বললো, ” তুমি না বললে আমিই তোমায় বলতুম জানো বৌদি, বুল্টির বাপটা না সরষে দিয়ে রুই মাছ বড্ড ভালোবাসে, দেখেই খুশি হয়ে যাবে।” বিনীতা ঝাঁঝিয়ে উঠে বলে, “হ্যাঁ ওই করো তুমি, লোকটা দিনরাত মদ গিলে বাড়ি ফিরে টাকার জন্য হাঙ্গামা করুক আর তুমি যত্ন করে মাছ গেলাও ওকে।”
মায়ের কথা যে লক্ষ্মী কাকিমার মনে খুব লাগলো সেটা মনেহলো না রাইয়ের। মাথাটা নিচু করে সে শুধু বললো, ” কি করবো বলো বৌদি। যাই করুক লোকটা, খাবার সময়ে ওরে না দিয়ে খেতে গেলে যেন গলা দিয়ে নামে না।”
রাই নিজের ঘরে ফিরে আসে অন্যমনস্ক হয়ে।একগাদা প্রশ্ন আর তার যুক্তিকতা যেন বারেবারে ঘুরছে রাইয়ের মনে। ঠাম্মুর বেরঙীন জীবনে কবে ফেলে যাওয়া দাদাইয়ের স্মৃতিটা ভালোবাসা! নাকি বাবার জন্য মায়ের দীর্ঘ প্রতীক্ষা ভালোবাসা, আবার নাকি লক্ষ্মী কাকিমার তার মাতাল বরের প্রতি নিঃস্বার্থ টানটা ভালোবাসা!ভালোবাসার রঙ তবে কোনটা? অন্যমনস্ক হয়েই ফোনটা হাতে নিতেই রাই দেখে তাতে সৃতমের মেসেজ। রাই মেসেজটা খুলতেই দেখে তাতে লেখা…
” বুঝলি, নতুন গিটার কিনবো বলে যেই টাকাটা জমাচ্ছিলাম সেটা বের করে নিলাম।ওটা দিয়েই ভ্যালেন্টাইনস ডে তে তোর পছন্দের একটা রেস্টুরেন্ট গিয়ে লাঞ্চ করবো। এবার তো স্মাইল কর!আর হ্যাঁ, কাল রাতে রুড হয়ে কথা বলার জন্য সরি।”
হঠাৎ করেই রাইয়ের মনটা যেন হালকা হয়ে যায়, এতক্ষণের সব কঠিন অংকের প্রশ্নের উত্তর মিলে যায় অনায়াসেই। ভালোবাসার মানুষের মধ্যেই যদি ভালো রাখার মানুষ আর ভালো থাকার মানুষ পাওয়া যায়!রাই একটা মুচকি হাসে, ভালোবাসার সত্যি কোনো রঙ হয়না হয়তো, যে যেমনটা ভাবে তার কাছে ঠিক তেমন।রাই রিপ্লাই করে সৃতমকে, ” নাহ, রেস্টুরেন্ট ক্যানসেল, দৌলতপুরের দিকে অনেকগুলো রোড সাইড ধাবা হয়েছে, এবারের ভ্যালেন্টাইনটা ওখানেই সেলিব্রেট করবো,তার সাথে ফাউ তোর বাইকে লং ড্রাইভ।আর হ্যাঁ, গিটারটা তুই কিনিস না, ওটা আমি গিফট করবো তোকে।”
©সম্পূর্ণা মজুমদার