যদিদং হৃদয়ং তব

‘মাঝে মাঝে তব দেখা পাই, চিরদিন কেন পাই না..’ সকালে নাচের স্কুলে মেয়েদের নাচ শেখাচ্ছে ঊর্মি। কিন্তু একটুতেই আজ যেন মেজাজ হারাচ্ছে বারবার। আসলে উর্মির মনটা কাল থেকে একদম ভালো নেই। ভেবেছিল নাচের ক্লাসটা আজ বন্ধ রাখবে। কিন্তু আগের সপ্তাহেও একদিন অফ করতে হয়েছিল, তাও আবার ওই.. থাক আর ওর নামটা একদম মনেও করতে চাইছেনা ঊর্মি। ধুর, মুড পুরো তেতো হয়ে গেছে। সবাইকে ছুটি দিয়ে বাড়ি চলে এলো ঊর্মি। ঘরে ঢুকে চুপচাপ খাটে বসে রইলো। হঠাৎ চেনা গলা পেয়ে চমকে ওঠে ঊর্মি। রূপ এসেছে।

-কিরে? সকাল থেকে ফোন করছি, ধরছিস না। মেসেজের রিপ্লাই দিসনি, কি হয়েছে? তোর নাচের স্কুলে গিয়ে দেখি বন্ধ। তাই এখানে চলে এলাম।

-কি করতে এসেছিস এখন তুই? তোর না আজ তোর হবু বৌয়ের সাথে বেরোনোর কথা! যাবিনা?

-হ্যাঁ, সে তো বেরবো বিকেলে। ওর সাথে না বেরোলে হয় বল! আফটার অল, কদিন বাদেই বিয়ে আমাদের। এখন তো টাইম দিতেই হবে।

গা জ্বলে যাচ্ছে ঊর্মির। টাইম দিতেই হবে! ন্যাকামোর শেষ নেই! রূপ তো কখনো আগে এরকম ছিল না। নিজের ওপর নিজের রাগ হচ্ছে ঊর্মির। রূপ কতবার ওর মনের কথা বলেছিল ঊর্মিকে। ইকো পার্কের ঝিলের ধারে দাঁড়িয়ে হাঁটু ভাঁজ করে প্রোপোজ পর্যন্ত করেছিল! ওর জায়গায় অন্য মেয়ে থাকলে নির্ঘাৎ রাজি হয়ে যেত। কিন্তু না, ঊর্মি রাজি হয়নি। ঊর্মির মনে হয়েছিল তারা শুধুই খুব ভালো বন্ধু। সেদিন কেঁদে দিয়েছিল রূপ। বলেছিল আর কোনোদিন ঊর্মিকে এই নিয়ে কিছু বলবেনা। সেই ঘটনার পর থেকে রূপ একদম স্বাভাবিক ব্যবহার করতো ঊর্মির সাথে, কিন্তু ঊর্মির মধ্যে আস্তে আস্তে বদল আসছিল। ধীরে ধীরে ঊর্মিও ভালোবেসে ফেলে রূপকে। ভেবেছিল সামনের সরস্বতী পুজোর দিন রূপকে সবটা জানাবে। কিন্তু তার আগেই.. কালকে নাচের স্কুল থেকে ফিরে সবে ফ্রেশ হয়ে বসেছিল ঊর্মি। তখনই রূপের ফোন আসে। রূপের কোন দূরসম্পর্কের দাদা রূপের জন্য একটা সম্বন্ধ এনেছে। রূপ নাকি কদিন ধরে কথাও বলেছে সেই মেয়েটার সাথে! অবশেষে কাল সন্ধেবেলা দুই পরিবার একসাথে হয়ে বিয়ের তারিখ ফাইনাল করে। ঊর্মি হাঁ হয়ে গেছিলো কথাগুলো শুনতে শুনতে। এতদিন এতকিছু চলেছে, রূপ কিছুই বলেনি! আজ বিয়ের তারিখ ফাইনাল হওয়ার পর জানাচ্ছে! রাগে ফোন কেটে দিয়েছিল ঊর্মি। পরে রাতের বেলা রূপ ঊর্মির বাড়িতে আসে। ঊর্মি আর রূপ ছোটবেলার বন্ধু। তাই রূপের ঊর্মির বাড়িতে অবারিত দ্বার। ঊর্মির মা ও রূপকে নিজের ছেলের মতোই দেখে।

-কিরে? ফোন কেটে দিলি তখন, তারপর সুইচড অফ্ বলছে। কি ব্যাপার?

-কি ব্যাপার মানে? তোর বিয়ে ঠিক হয়ে গেল রূপ আর তুই সেটা আমাকে আজ বলছিস? একটা মেয়ের সাথে তোর এতদিন ধরে কথা হচ্ছে আমি জানতেও পারলাম না! বাঃ!

-কি করতিস জেনে? আমরা তো শুধু বন্ধু ঊর্মি, তাই না? আর বন্ধুকে বিয়ে ঠিক হয়েছে, জানিয়েছি।

-রূপ তুই…

আজকের দিনটা অন্যরকম হতে পারতো ঊর্মি। একদম অন্যরকম। যাকগে, তুই আমার ছোটবেলার বন্ধু, আমি চাইব আমার বিয়ের সবকিছুতে তুই থাকবি, কোনোদিন তো কিছু চাইনি তোর থেকে, এটাই চাইলাম আজ। বিয়ের কেনাকাটা থেকে বাসর রাত, সবটায় তুই থাকবি। বলেই বেরিয়ে যায় রূপ।

-কিরে? কোথায় হারিয়ে গেছিলি? যাই হোক, চল এখন আমাদের বাড়ি, মা তোকে ডেকেছে। তাই তো তোকে ফোন করেছিলাম।

-কাকিমা আমাকে ডাকছে? কেনো?

-সেটা আমি কি করে জানবো বল? চল তো আগে, চল চল..

রূপের বাড়ি গিয়ে ঊর্মি দেখে রূপের মা গয়নার বাক্স নিয়ে বসে আছে। ঊর্মিকে দেখে কাছে ডাকেন উনি।

-দেখ তো এর মধ্যে কোনটা রূপের বউকে দেবো? তুই তো ওর কত ছোটবেলার বন্ধু। তোর চেয়ে বেশি ওকে আর কে চেনে বল। তুই দেখ দেখি!

-কাকিমা আমি কি করে এসব.. তুমি দেখনা, যেটা তোমার ভালোলাগে।

-না আমি জানিনা, আমার তো মেয়ে নেই, সেই কবের থেকে তোকেই তো মেয়ে বলে জানি। তুই-ই দেখে দে। তাড়াতাড়ি সব করতে হবে জানিস তো। বিয়ের তো খুব বেশি দেরি নেই। আসলে মেয়ের বাড়ি থেকে না খুব তাড়াতড়ি বিয়ে দিতে চায়। আমিও আর আপত্তি করিনি। রূপের বাবা তো নেই, আমি সুস্থ থাকতে থাকতে ওর একটা হিল্লে হলে আমারও তো শান্তি বল।

কোনোমতে একটা হার বেছে দিয়ে বাড়ি চলে আসে ঊর্মি। বিছানায় শুয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদে ওঠে। হায় ঈশ্বর! নিজের ভুলে আজ যেনো ও সবকিছু হারিয়ে ফেলছে মনে হচ্ছে ঊর্মির। রূপকে ভালোবাসতে কেনো এতো দেরি করে ফেললো ঊর্মি! ওই বাড়িটা, যেখানে ঊর্মির দিনের বেশিরভাগ সময়টাই কেটে যেত, সেই রূপের ঘরটা.. সেখানে এখন অন্য কেউ থাকবে। ভাবতেই আরও কান্না পাছে ঊর্মির। রূপ দূরে চলে যাবে ওর থেকে? আর আগের মতো রূপকে পাবে না যখন তখন? নাহ্, আর কিছু ভাবতে পারছেনা ঊর্মি। কাঁদতে কাঁদতে কখন ঘুমিয়ে পড়েছে বুঝতেই পারেনি। ফোনের আওয়াজে ঘুম ভাঙলো ঊর্মির। রূপের ফোন। “হ্যালো, শুনতে পাচ্ছিস? দেখা করলাম বুঝলি? একদম আমার মতই রে, ওর ও রবীন্দ্রসঙ্গীত খুব প্রিয়, আর প্রিয় খাবার কি জানিস? ফ্রাইড রাইস আর চিলি চিকেন! উফ্, ফাটাফাটি! এই দাঁড়া বাড়ি ফিরছি, ঢুকে কল করছি তোকে..” ঊর্মি কিছুই বলার আগেই ফোন কেটে যায়। রাগে বিছানাতেই ঘুষি চালায় ঊর্মি। ফ্রাইড রাইস আর চিলি চিকেন তো ঊর্মিরও প্রিয় খাবার। সেটা কি রূপ এর মধ্যেই ভুলে গেলো? ঠিকাছে, রূপ এতেই খুশি থাকলে এটাই ঠিক। ঊর্মিও আর কিচ্ছু ভাববেনা এই নিয়ে। রূপের বিয়েতে ঊর্মি ফাটিয়ে নাচবে। চোখের জল মুছে ব্যালকনিতে দাঁড়ায় ঊর্মি। সবার সব ইচ্ছে তো পূর্ণ হয়না। তাছাড়া রূপ তো এসেছিল ওর কাছে, ওই-ই ফিরিয়ে দিয়েছে বারবার। ঊর্মির এই স্বপ্নটা অধরাই নাহয় থাকলো। ঘরে এসে এপাশ ওপাশ করতে করতে ঘুমিয়ে পড়ে ঊর্মি।

 

মাঝখানের কয়েকটি সপ্তাহ যেনো পলকে কেটে গেল। রূপের বিয়ের সব কিছুতে ঊর্মি থেকেছে। বিয়ের কেনাকাটা থেকে শুরু করে বিয়ের কার্ড বাছাই করে দেওয়া, সব ঊর্মি করেছে। বুকের ভেতরটা ছারখার হয়ে যাচ্ছে যেন ঊর্মির, কিন্তু দাঁতে দাঁত চেপে সব সহ্য করেছে সে। আজ তার শেষ দিন। আজ রূপের বিয়ে। আজ সকাল থেকে কিছুতেই যেন আর পা চলতে চাইছিল না ঊর্মির। কিন্তু মা এমন জোরাজুরি করলো, বাধ্য হয়ে রূপের গায় হলুদের সময় যেতে হলো ঊর্মিকে। রূপের সাথে সাথে ওকেও সবাই আচ্ছা করে হলুদ মাখালো। রূপের মুখে আজ খুশি উপচে পড়ছে যেন। ও কি সবকিছু সত্যিই ভুলে গেলো? একদিন তো রূপ সত্যি ভালোবেসেছিলো ঊর্মিকে, সেটা কি মিথ্যে ছিলো? উফ্! আবার ঊর্মি এসব ভাবছে! নিজের মনকে শক্ত করলো ঊর্মি। নাহ্, শুধু আজকের দিনটা। এরপর ঊর্মি চলে যাবে। শিলিগুড়িতে ওর একজন বন্ধুর নাচের বড়ো স্কুল আছে। অনেকদিন ওকে বলেছিল ওখানে গিয়ে শেখাতে। ঊর্মি রাজি হয়নি। কিন্তু এইবার ওখানে চলে যাবে। কথাও বলে নিয়েছে। সবার থেকে দূরে গিয়ে ভালোই থাকবে ঊর্মি, হয়তো..

অবশেষে সন্ধে হলো, খুব সুন্দর করে সাজলো ঊর্মি, কিন্তু বেনারসি পরার ইচ্ছে ছিলো না, মা খুব জোর করলো। একটা ব্যাপার লক্ষ্য করেছে ঊর্মি, রূপের বিয়ের খবরটা পাওয়ার পর থেকে মা একটু বেশিই খুশি। বাবাও দেখছি খুব সাজছে আজকে! মা দোকানে গিয়ে বিয়েতে পরার জন্য নতুন শাড়ি কিনেছে। ঊর্মির জন্য বেনারসি কিনেছে। ঊর্মি আপত্তি করেছিলো, শোনেনি।

বিয়ের গেটের সামনে দাঁড়িয়ে আছে ঊর্মি, পা আর নড়ছে না যেন। কান্নাটা গলার কাছে অনেক কষ্টে আটকে আছে। কি করে রূপের বিয়ে দেখবে বুঝতে পারছে না ঊর্মি। হঠাৎ রূপের কাকু ঊর্মিকে দেখে ভেতরে নিয়ে যায়। রূপকে বর বেশে দেখে আর নিজেকে সামলাতে পারেনা ঊর্মি। সবার সামনে ভ্যাঁ করে কেঁদে দেয় সে! ছুটে রূপের কাছে গিয়ে এক নিমেষে বলে যায়, “আমি তোকে খুব ভালোবাসি রূপ, আমি আগে বুঝতে পারিনি বিশ্বাস কর, কিন্তু সেই ইকো পার্কের সামনে যেদিন তুই কেঁদে দিয়েছিলি সেদিন প্রথম বুঝতে পেরেছিলাম তুই কাঁদলে আমার খুব কষ্ট হয়। তারপর যখন বুঝতে পারি আমার ফিলিং, তখন তুই বললি তোর নাকি বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে! বিশ্বাস কর, নিজেকেও অনেক সামলানোর চেষ্টা করেছি, নিজেকে বুঝিয়েছি, কিন্তু তোকে বরের সাজে দেখে আর নিজেকে কন্ট্রোল করতে পারলাম না। তোকে খুব ভালোবাসি রূপ, খুব ভালোবাসি..” বলতে বলতে হঠাৎ হুঁশ ফেরে ঊর্মির। এবাবা! এটা কি করলো ঊর্মি! এতগুলো লোকের সামনে এভাবে রূপকে.. আর আজ তো রূপের বিয়ে! লজ্জায় কান লাল হয়ে গেলো ঊর্মির। রূপকে সরি বলতে গিয়ে দেখে রূপ মিটিমিটি হাসছে! কি ব্যাপার? রূপ কি তামাশা করছে ওকে নিয়ে? হঠাৎ পেছনে হাসির শব্দ করে তাকিয়ে অবাক হয় ঊর্মি। একি! মাসী- মেসো, পিসি- পিশু, ওর সব বন্ধুরা, এমনকি শিলিগুড়ির সেই বন্ধুটাও দাঁড়িয়ে এখানে! কিন্তু এরা এখানে..

-কিরে? মুখ হাঁ হয়ে গেল তো? তাহলে আমিও তোকে একটু আধটু কষ্ট দিতে পারি বল?

-মানে? এসব কি হচ্ছে? আমি তো কিছুই বুঝতে পারছিনা!

-মানে আবার কি? আজ তোর আর আমার বিয়ে!

সবাই কি মজা করছে ওর সাথে? ঊর্মি এতটাই অবাক হয়ে গেছে যে কি বলবে সেটাই যেন বুঝতে পারছে না। রূপের মা এগিয়ে এসে ঊর্মিকে জড়িয়ে ধরলো।

“মারে, রূপ তোকে ছাড়া কাউকে বিয়ে করতে পারে বল? ও তো সেই ছোট্ট থেকে তোকেই ভালোবাসে। আমরা দুই পরিবার তো এটাই চেয়েছিলাম। কিন্তু  তুই তো নিজের মনের কথা বুঝতে পারছিলিসনা, তাই রূপ এই বুদ্ধিটা বের করলো। আমি কিন্তু শুরুতে আপত্তি করেছিলাম। কিন্তু পরে তোদের ভালোর জন্যই রাজি হয়েছি। তোরা ছোট থেকে একডালে ডানা ঝটপটানো পাখি, অন্য গাছে কি তোদের মানায় বল?” ঊর্মি আবার কেঁদে ফেলে। রূপ এসে ঊর্মির কাছে দাঁড়ায়।

-খুব মারবো তোকে, এইভাবে আমাকে কাঁদালি?

রূপ কানের কাছে এসে ফিসফিস করে বলে, “মারটা নাহয় ফুলশয্যার জন্য তোলা থাক!”

-যাঃ! লজ্জায় মুখ ঢাকে ঊর্মি!

 

Facebook Comments Box

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *