॥ হিয়ার মাঝে (অন্তিম পর্ব) ॥
রিনির সঙ্গে হিয়ার কথোপকথনে রিনির বক্তব্যের সংক্ষেপ ছিল কিছুটা এরকম যে রিনি এবং প্রকাশ অনেকদিন ধরেই দুজন দুজনকে চায় এবং তারা শুধুমাত্র বন্ধু নয়, বন্ধুত্বটা শুধুমাত্র একটা লোক দেখানো তকমা বই কিছু নয়। আর প্রকাশ হিয়ার সাথে এতদিন যা যা আচরণ করেছে ওটা নেহাতই কদিনের মোহ, যেরকম আকছার অনেক মেয়ের প্রতিই আসে যায়। তাই হিয়া যেন প্রকাশের থেকে বেশি কিছু আশা না করে। আর রিনি এবং প্রকাশের মাঝে ঢোকার যে কোনো অধিকারই হিয়ার নেই তাও স্পষ্ট কথার বাঁধুনিতে বুঝিয়েছিল রিনি।
রিনির মুখ থেকে এসকল কথা শোনার পর হিয়ার হৃদয় তাসের ঘরের মত ভেঙে পড়েছিল। প্রকাশের সম্পর্কে তৈরী হওয়া সমস্ত ধারণা অচিরেই পাল্টে যেতে শুরু করে এবং একটা সম্পর্ক শুরু হওয়ার আগেই তার সমাপ্তি ঘটে।
দিনের পর দিন যত এগোতে থাকল হিয়া নিজের মনটাকে আস্তে আস্তে প্রকাশের দিক থেকে গোটাতে শুরু করল। তার ক্ষণিকের ভুল ধারণা, মিথ্যে চাওয়া-পাওয়াগুলোকে বারবার সংশোধন করতে চাইল। তবু পরিস্থিতির চাপ আর প্রকাশের সঙ্গে কাটানো প্রতিটা মুহূর্ত যেন ঘুরে ফিরে তার মাথায় এসে বলে যেতে লাগল যে সে ভালোবেসে ঠকেছে। প্রকাশের কাছে সে অন্য সব সাধারণ মেয়েদের মতই একজন, এর চেয়ে বেশি কিছুই নয়। তার ভালো লাগার, ভালো থাকার মুহূর্তগুলোকে যেন এক নিমেষে ম্যাজিক করে উড়িয়ে দিল।
হিয়ার মন ভাঙল, রিনির মন শান্ত হল। শুধু এসব কিছুর থেকে অজান্তে রয়ে গেল একজন, প্রকাশ। সে বিন্দুমাত্র আঁচ করতে পারেনি যে তার প্রিয় বন্ধু তার ভালো থাকার দিনগুলো নিষ্ঠুরের মত কেড়ে নিয়েছে তার থেকে।
রিনির কাছ থেকে প্রকাশের সম্পর্কে যাবতীয় কথা শোনার পর হিয়া এক মিথ্যে সম্পর্কে থাকার নাটক শুরু করেছিল। খুব সন্তর্পণে এবং খানিকটা জেদের বশেই সে প্রকাশের কানে তার মিথ্যে সম্পর্কের কথাটা তুলতে চেয়েছিল এবং বলাবাহুল্য সে সফলও হয়েছিল। বুকের ভিতর চাপা কষ্ট রেখে হাসিহাসি মুখে তার কাল্পনিক প্রেমিকের গল্পও করেছিল বইকি প্রকাশের সঙ্গে। স্বাভাবিক থাকার অভিনয়টা সে এতটাই পারদর্শীতার সঙ্গে করেছিল যে প্রকাশের কোনোরকম অনিশ্চয়তা জাগেনি তার সম্পর্কে থাকা নিয়ে।
অতঃপর রিনির পরিকল্পনা মাফিক বেশ মসৃণভাবে হিয়া আর প্রকাশের মধ্যে দূরত্ব সৃষ্টি হয়। প্রকাশ এবং হিয়া দুজনেই দুজনের পথ আলাদা করায় প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হয়। অলক্ষ্যে থেকে রিনির সুপ্ত ভালোবাসারই জয় ঘটে। হিয়াকে প্রকাশের মন থেকে মুছে ফেলার চেষ্টায় রিনি কিছুটা হলেও সফল হয়।
আসলে মানুষ যা চায় ভবিতব্যে তা হয়না। আবার অনেক সময় এরকমও হয় যে একজন তার অপর প্রান্তের মানুষটার ভাবনা-চিন্তা সম্পর্কে তার নিজের মন গড়া কিছু ধারণা করে নেয় এবং সেটাকেই মনে পুষে রাখে। একবারও খোঁজ নেওয়ার চেষ্টা করেনা যে ওপাশের মানুষটার মনে আসলে কী আছে। আর দুই মানুষের এই দোটানার মধ্যে জিতে যায় কোনো এক তৃতীয় ব্যক্তি। রিনি-প্রকাশ-হিয়ার সম্পর্কের সমীকরণও কিছুটা এরকমই।
এইসমস্ত মান-অভিমান, বেদনা, কষ্টের পর্ব চলার বেশ কিছুদিন পর আজ এই পিকনিকের সূত্র ধরে আবার প্রকাশ এবং হিয়া মুখোমুখি। প্রকাশের প্রশ্ন করার পালা হিয়াকে। তার মনে একটাই প্রশ্ন চরকির মত ঘুরপাক খাচ্ছে অনবরত, যা প্রথম দিন সেই প্রথম ভালোলাগার মুহূর্ত থেকে জিজ্ঞাসা করার জন্য ব্যাকুল হয়ে আছে।
“তোমার হিয়ার মাঝে কি কোথাও আমি লুকিয়ে ছিলেম ?”
হিয়া কি এর উত্তর দেবে?
হয়তো না কিংবা হয়তো হিয়া নিজেও এর উত্তর জানেনা!
হয়তো ওদের হিয়ার মাঝে যা লুকিয়ে আছে তা চিরকাল নাম না জানা স্মৃতি হয়েই রয়ে যাবে! হয়তো… হয়তো বা…!