আজকে সবার কাছে আমার একটা ছোট প্রশ্ন “বংশ কি?”
অনেকেই হয়তো আমার উপর রেগে গিয়ে গালমন্দ করবেন। বা বলবেন কোন ধরনের লেখা এটা।
এক মিনিট। একটু থামুন। কিছু কথা বলার আছে।
এটা সাধারণ ব্যপার যে,আমাদের পুরুষতান্ত্রিক সমাজে বংশ বলতে বাবার পরিবারকে বোঝায়। অধিকারের ক্ষেত্রেও প্রাধান্য বেশি পায় বাবার পরিবার। তাহলে মায়ের পরিবার কি?
আচ্ছা। আর একটু সহজ করি ব্যপারটা।
যে শিশুটার শৈশব মায়ের পরিবারের সাথেই কেটেছে।নানা,নানু,মামা,মাসীর সাথে কেটেছে,যার শৈশবের স্মৃতিতে কাকা,দাদু, দীদা,পিসি কেউই নেই সেই শিশুটার বংশ কোনটা?
অথবা যে শিশুর শৈশবের স্মৃতিতে বাবা বা মা উভয় পরিবারের,কারোর কোনো পদচিহ্ন নেই, সেই শিশুটার বংশ কোনটা?
পরিবারের মধ্যে এমন অনেকেই আছেন যাদের খোঁজ, নিজের জীবনবৃত্তান্তে কিংবা স্মৃতিতে সহজে পাওয়া যায় না,অথচ তারাই ভরপুর জনসভায় বুক ফুলিয়ে বলে,”দেখতে হবে না কোন বংশের ছেলে বা মেয়ে”।
আমার জানতে ইচ্ছা হয় তোমরা তখন কোথায় ছিলে যখন তোমাদের প্রয়োজন ছিলো?
একটা মানুষ ছোটবেলা থেকে যা দেখে তাই শিখে,তাই আপন করে নেয়। ছোটবেলায় যাদের সান্নিধ্য শিশুরা পেয়ে থাকে তাদেরকে ঘিরেই শিশুটার পরিবার। এখন সেই শিশু যখন একটু বুঝতে শিখে,বা বয়ঃপ্রাপ্ত হয় তখন কোনো অপরিচিত মুখ এসে যদি বলে “আরে খান্দানের প্রদীপ” বা “আমাদের রক্ত”। এমন সময় সেই কিশোর বা কিশোরীর মনে রাগ হবে ,তাই স্বাভাবিক। যারা আদর করে,ভালোবেসে মানুষ করলো তাঁরাও এতো অধিকার জমায় না যতটা অপরিচিত মুখটা জমাচ্ছে। ব্যপারটা এমন হয়ে দাঁড়ায় যে, পরিশ্রম কেউ করলো,ফল আরেকজন পেলো।
মায়ের পরিবারে লালিত পালিত মেয়েটা যে, একটা সময় পর্যন্ত জানতোই না তার দাদু বাড়ি আছে,তার কাকা আছে,পিসি আছে সেই মেয়েটার সামনে হুট করে হাজির হয়ে বলছো যে,”তুই আমাদের বংশের মেয়ে”- এই যে এভাবে বললেন, এই বংশটা নির্ধারণ করে কে?
‘ যে মানুষগুলো তোমার শৈশব,কৈশোরে,তোমার আনন্দ,দুঃখের অংশ ছিল বা আছে ,সত্যিকার অর্থে তারা হচ্ছে তোমার বংশ।’ এমন হওয়া উচিত বংশের সংজ্ঞা।
মাতৃতান্ত্রিক সমাজে মায়ের দিকটাই বংশ বলে বিবেচিত।” রক্ত ” ,”আমাদের রক্ত” বলে যারা চেঁচিয়ে যায়,তারা কি জানে সন্তানের শরীরে মায়ের রক্ত নাকি বাবার রক্ত বহমান?
এতটুকু তো সবাই জানে গর্ভে থাকা অবস্থায় গর্ভধারিনী যা আহার করেন তা থেকেই শিশু পুষ্টি পায়। পরবর্তীতে শিশুর রক্তের ধরণ বাবারও হতে পারে, মায়েরও হতে পারে আবার ভিন্নও হতে পারে।
একটা শিশু কখনো বাবার বা মায়ের একার হয় না। দুজন থেকেই জিন পেয়ে থাকে।
তাই কোনো এক বংশের বলে,কোনো মানুষকে সংজ্ঞায়িত করা, আমার উচিত মনে হয় না।
এই গেলো বিজ্ঞানের দৃষ্টিভঙ্গি। এইবার আসি সামাজিকতায়।
আমরা কাদের শ্রদ্ধা করি,কাদের বিশ্বাস করি,কাদের ভালোবাসি,কাদের কাছে প্রিয়, এইসব কিছুই গুরুত্বহীন,বংশের সংজ্ঞা দিতে গেলে। সব কিছুর উর্ধ্বে দাঁড়ায় আমরা কোন সমাজে বাস করি,মাতৃতান্ত্রিক না পিতৃতান্ত্রিক। কিন্তু কেন? কেন অধিকারটা তাদের কম বা বেশি নির্ধারিত হয় না, ভালোবাসার দিক থেকে,বিশ্বাসের দিক থেকে। কেন বংশ বাবার বলে সারাজীবনে যে মানুষগুলোকে খুঁজে পাই নি তাদেরকে অধিকারের কাটগোড়ায় প্রাধান্য বেশি দিতে হবে?
ব্যপারটা যদি এমন হতো যে, যেই দিকটাকে বংশ হিসেবে মেনে নিতে চায়,সে সেই বংশের পরিচয় নিয়ে বাঁচতে পারতো,তাহলে বেঁচে থাকার প্রক্রিয়াটা আর একটু সহজ হতো। যেমন কেউ একজন বলতে পারে,
আমার শৈশব আমার নানাবাড়ীতে কেটেছে। মামার বুকে ঘুমিয়ে,মাসীর সাথে খেলে। আমার বংশ, আমার উপর অধিকার আমার মায়ের পরিবারেরই বেশি। কারণ তারা আমার জন্ম থেকে পাশে ছিল। আমি তাদেরই বিশ্বাস করি,তাদের ভালোবাসি। তাদের সান্নিধ্যে থাকতে চাই। আমি বলছি না আমার বাবার বাড়ির পরিবার খারাপ,বা আমার উপর তাদের অধিকার নেই। আছে কিন্তু আমি ঠিক ততটা বিশ্বাস হয়তো রাখতে পারবো না যতটা মায়ের পরিবারের জন্য আছে।
ঠিক তেমনি অন্য কেউ বলতে পারে,
আমার শৈশব আমার দাদাবাড়ীতে কেটেছে।কাকার কাঁধে চড়ে, পিসির সাথে খেলে। আমার বংশ,আমার উপর অধিকার আমার বাবার পরিবারেরই বেশি। কারণটাও একদম একই।
পরিশেষে প্রিয় মানুষগুলোই বংশ নামক পরিচয় পেত । যারা অপ্রিয় তাদের সামনে বংশের মুখোশ টেনে বিশ্বাসের ছলনা করতে হতো না। এখন অপ্রিয় বলতে আবার শত্রু ভাববেন না। অপ্রিয় বলতে যাদের হয়তো আমরা সম্মান করি ঠিকই কিন্তু বেশি একটা কাছের অনুভব করি না।
যাই হোক, আমি বললেই তো আর সমাজ এবং এই সমাজের সমাদৃত অদ্ভুত প্রথার, চুল পরিমাণও পরিবর্তন আনবে না। তার চেয়ে বরং আপনিও আপনার কাজে যান। সময়টা নষ্ট করার জন্য ধন্যবাদ।