অন্য মা
ভেউ ভেউ করে হাপুস নয়নে কান্না । মা বাবা কেউ ছোট্ট লিলি কে ধরে রাখতে পারছে না। যৌথ পরিবারে বেড়ে ওঠা সবার আদরের ধন তাও আবার বাড়ির প্রথম সন্তান ছোট্ট লিলি এই প্রথম তার মামমাম কে ছেড়ে এত দূরে থাকবে। না না মামমাম মানে তার মা নয় , জেঠিমা। ট্রান্সফারের চাকরির সুবাদে নিজেদের বাড়ি ছেড়ে অচেনা শহর আসানসোলে সংসার পাততে হয়েছে তার মা বাবার। বড়ো ট্রাকে করে মালপত্র গুছিয়ে আনা যেমন ঝক্কির কাজ ছিলো তেমনি ছোট্ট লিলিকে শিকড় ছিড়ে ভুলিয়ে নিয়ে আসা ছিলো আরো শক্ত। নতুন সরকারি হাউসিং এর ঘরে ঢুকতেই সেই বিপত্তি ঘটলো। এতো খাঁ খাঁ করা ফাঁকা ঘর। মামমাম কোথায়?? নেই তো। ঘরে ঢুকেই যার কোলে প্রথম ঝাঁপিয়ে পড়তো লিলি। চেনা মুখ খুঁজে না পেয়ে স্বজন হারানোর কান্না জুড়েছে সে। মা বাবা না হলেও তার চলবে কিন্তু মামমাম তার চাই।
এমন সময় গল্পে পড়া দেবদূতের মতো এসে হাজির হলো সে। দু হাতে লিলি কে বুকে জড়িয়ে বললো “এই তো আজ থেকে আমি তোর মামমাম “। একমুহূর্তের জন্য কান্না ভুলে শান্ত হলো নিষ্পাপ শিশু। অবাক চোখে চেয়ে দেখলো সেই মানুষটিকে।
স্নেহের পরশে সেদিন যিনি সেই ছোট্ট শিশুটিকে বুকে টেনে নিয়েছিলেন তিনি আর কেউ নন। লিলি দের উল্টো দিকের প্রতিবেশী সোনালী দেবী।। অপরিচিত একটা শিশুর ফুঁপিয়ে কান্না তার হৃদয়কেও আন্দোলিত করেছিলো। মায়াভরা মুখ ফর্সা টুকটুকে ঝুটি বাঁধা পুঁচকে লিলির মামমাম হয়ে উঠতে তিনি একবারও ভাবেননি। ক্ষনিকের জন্য লিলি সেই মমতা ভরা আলিঙ্গনে শান্ত হয়ে কান্না থামিয়েছিলো।
আমরা যারা বসতভিটের শিকড় ছিন্ন করে চাকরির রক্ষার্থে অজানা কোনো নতুন দেশে নতুন পরিবেশে এসে পা রাখি তখন হয়তো এভাবেই কেউ এসে আমাদের পাশে দাঁড়ায়। পরিচিত না হয়েও নিমেষে আমাদের পরিজন হয়ে ওঠেন। প্রাপ্তবয়স্ক মানুষেরা মানিয়ে নিয়ে চলতে সক্ষম হয়ে যাই কিন্তু শিশু মন কে বোঝানো যায় না। তারা সর্বত্র চেনা মুখ খুঁজে বেড়ায় । জেঠিমা কাকিমার ভালোবাসা দিয়ে আগলে রাখা ভুলে যাওয়া তাদের জন্য কঠিন হয়ে পড়ে।
আজ সাত বছর পার। বালিশের মুখ গুজে লিলির কান্না। ছেড়ে যেতে হবে যে। বাবার আবারও ট্রান্সফার হয়েছে। সাত বছরে এই আসানসোল তার রন্ধ্রে রন্ধ্রে মিশে গেছে । খেলার মাঠ ,কত বন্ধু, কত কাকু , কাকিমা ,দিদি দাদা জেঠু জেঠিমা দের পেয়েছে সে। সবাই মিলে যেন একটা পরিবার। সবাই সবার ভরসার স্থল। একদিন ঘর ছেড়ে এখানে এসেছিলো সে। আজ সেই জায়গা ছেড়েই পাড়ি দিতে হবে আবার অন্য কোনো খানে। আবার যেন ছিন্নমূল হওয়ার যন্ত্রনার ভাগীদার হলো লিলি।
সবার শৈশবে জীবনে এমন কোনো কাকী “মা” জেঠি “মা” , পিসি “মা” দের অস্তিত্ব আছে।যাদের আঁকড়ে আমরা বেড়ে উঠি। শুধু চেনা জগতে নয়। অচেনাদের ভিড়ের মাঝেও ঠিক এরকম কোনো ” মা” আমাদের আপন করে নেয়। নতুন পরিবেশে অভ্যস্ত হতে
সাহায্য করে । লিলির জীবনে এমন স্নেহের আঁচল বিছিয়ে দিয়েছিলেন এক অন্য মা। কান্না ভুলে সে কচি দুটো হাত বাড়িয়ে বলেছিলো “মামমাম”