আমি তিতির (প্রথম পর্ব)
“আচ্ছা ধরুন, একটা শীতের মরশুম আর কিছু মানুষ, পশুপাখি, গাছপালা, শহর, ফুটপাত ইত্যাদি । এই সবগুলোই তো একে অপরের পরিপূরক । মানে, ব্যাপারটা হলো, ধরুন রাস্তায় ঝরা পাতার উপর শিশির না পড়ে, তাহলে কি মাথায় কাব্যি আসে ? তো এই শীতের সকালে—”
হঠাৎ আমার মোবাইল টা বেজে উঠলো । মাথা থেকে সব ছন্দ কেটে গেলো । ধীরে ধীরে ডায়েরিটাকে বন্ধ করলাম । তখনও ফোনটা বেজে চলেছে । ফোনটা হাতে নিয়ে দেখলাম মায়ের ফোন।
—‘হ্যালো’।
—‘হ্যালো, তুমি কোথায়?এখনো পার্কে? তাড়াতাড়ি ঘরে ফিরে এসো,তোমায় আজ যেতে হবে সেটা খেয়াল….’
(আমার নাম বোধহয়, তিতির , আমার ১৯ বছর বয়স । সবাই বলে— আমি ছোট থেকে Social anxiety disorder -এর শিকার , আমি সবার সাথে মিশতে ভয় পাই আর আমি হঠাৎ হঠাৎ আমার subconscious mind -এ হারিয়ে যাই । এর জন্য আমায় প্রত্যেক সপ্তাহে ডাঃ রায় -এর কাছে যেতে হয় । মা ভাবে আমি ঠিক হয়ে যাব । কিন্তু আমি ঠিক হতে চাই না….)
—‘…তিতির তুমি আবার অন্যমনস্ক হয়ে পড়েছো ? আমি কি বললাম তুমি…’
(মা আবার আমার চিন্তায় দাঁড়ি টানলো)
—‘…হমমম্,শুনেছি—যাচ্ছি’ ।
ঘড়িতে ১১ টা—আমাকে মা প্রায় মেরে ধরে ডাঃ রায়কাকুর কাছে চেম্বারে নিয়ে গেল । আ্যপয়েন্টমেন্ট আগে থেকে নেওয়া ছিল ।
as usual চেম্বারে ঢুকলাম, কালো চেয়ারে বসতে বললেন । তারপর শুরু হলো সেই ঐতিহাসিক পেপটক ।
—‘এখন কেমন আছো তিতির মা ?’
(অদ্ভুত রকমের বোকা প্রশ্ন )
—‘ Never better ,কাকু । ’
মা কিছু না বুঝে চেঁচিয়ে উঠলো,
—‘না,ডাক্তারবাবু ও এখনো প্রচুর অন্যমনস্ক হয়ে পড়ে,ভীড় দেখলে ভয়ে কেঁদে ফেলে। ’
—‘উফফ্ মা প্লিজ’।
—‘Ok,ok calm down,দ্যাখো তিতিরমা তোমার বাবা, মা, আমি আমরা সবাই চাই তুমি ভালো হয়ে ওঠো । সবার সাথে মিলেমিশে থাকো, আনন্দ করো …
(বাবা !! বাবা চায় আমি ভালো থাকি ? যে বাবা জন্মের সময় চেয়েছিল তার ছেলে হোক কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত আমি চলে আসি । ঠিকমতো কথাই বলে না আমার সাথে । সেই বাবা চায় আমি ভালো থাকি ?)
-…তিতিরমা বুঝলে কি বললাম ?’
—‘উমমম্,হ্যাঁ বুঝেছি, মা আমার খিদে পেয়েছে বাড়ি চলো’।
চেম্বার থেকে বেরিয়ে আমি আর মা একটা ট্যাক্সি ধরলাম । বেশ কিছুক্ষণ চুপচাপ থাকাটা বোধহয় মা মেনে নিতে পারলো না । ট্রাফিকে গাড়ি দাঁড়াতেই—
—‘দ্যাখ তিতির, আমি জানি ডাক্তারবাবুর কথা তুই কিছুই শুনিসনি,বারবার ঘামছিলি দেখে ডাক্তারবাবু তোকে নিয়ে চলে যেতে বললো’
—আমার নিরুত্তাপ থাকাটা মা সহ্য করতে পারলো না । আবার বকা চালু হলো ।
— ….তিতির এদিকে তাকা, কেন এমন করিস? একটু কথা শোন না । ’
—‘বলো শুনছি । ’
—‘না তুই শুনছিস না…
(মা কেন এতো বকে ?কই ঐ ট্রাফিকে ফুল বিক্রী করা ছেলেটাকে তো কেউ বকে না । ওকে তো কেউ বলে না ‘অ্যাই তুই পড়াশুনো না করে রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে বেড়াস কেন?’ বা ঐ রাস্তার পাশে আপন মনে বিড়বিড় করতে থাকা পাগলটা,ওকে কেন কেউ ডাক্তার দেখায়না? বা বুড়ি ভিখিরিটা । সবচেয়ে অদ্ভুত বিষয় এরা প্রত্যেকে ঐ ট্রাফিকের লাল আলোটার উপর নির্ভরশীল,ঐ লাল আলো জ্বললেই ছেলেটা ফুল নিয়ে রাস্তার উপর আসে,পাগল অবাক হয়ে গাড়ির ভিড় দেখে,বুড়ি ভিখিরিটা ও দুটো পয়সার জন্য—’
—..তিতির!! এবার তুই বড্ড বাড়াবাড়ি করছিস,তুই আবার—’
মা আরো কিছু বলতে যাচ্ছিল, তার আগেই ট্যাক্সির বন্ধ জানলায় একটা ধূলো ভর্তি কঙ্কালসার….
(ক্রমশ )