(আমার নাম বোধহয় তিতির । আমার বয়স ১৯ । আমি ছোটো থেকে social anxiety disorder শিকার । আমি ভাবতে ভালোবাসি । আর এটা আমার গল্প )
আচ্ছা কখনো কেউ রাতের আকাশের দিকে একমনে চেয়ে , তারাগুলোর কথা ভেবেছে ? কখনো কি ভেবেছে ? এই যে এত্তো গুলো তারা একসাথে গাদাগাদি করে থাকে তারা কি একে অপরকে চেনে ? নাকি শুধু নিজেদের ঝকমকি দেখাতেই ব্যস্ত থাকে ? ধুসস্ , আমিও না , আরে ওরা পাশাপাশি থোড়াই থাকে , আমরা অনেকটা দুর থেকে দেখি বলে ওরম মনে হয় । ঠিক যেমন আমরা , যদি আমরা দুর থেকে কোনো মানুষের ভিড় দেখি মনে হয় , ‘ ওরে বাবা সবাই একসাথে ওখানে কি করছে ?’ কিন্তু যদি আমরা খুব কাছ থেকে দেখি তাহলে বুঝতে পারবো যে , এরা সবাই আলাদা , এদের মন , কথা-বার্তা , সবকিছু আলাদা । আসলে আমরা সবাই একলা , কেউ কেউ এটাকে মেনে নিয়ে চুপ থেকে যায় । আবার কেউ কেউ এর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করে বন্ধুত্ব পাতায় । এই যেমন কয়েক ঘন্টা আগে অব্দি আমি এই লোকটিকে চিনতাম না …… )
—‘ম্যাডাম , ম্যাডাম —’
(উফফফ্ , সব জায়গায় কেউ না কেউ থাকবেই , আমার ভাবনাগুলোকে ঠোক্কর মারার জন্য)
—‘আপনি ঠিক আছেন তো ?’
—‘হ্যাঁ , কেন বলুন তো ? ’
—‘না মানে , আপনি হঠাৎ দাঁড়িয়ে পড়লেন তো তাই । ’
—‘না না ঠিক আছি চলুন আর কতো দুর ? ’
—‘এই তো প্রায় এসে গেছি । এই ডান দিক টা বেঁকে , আবার ডানদিকে গিয়ে সোজা কিছুটা গেলেই আমার বাড়ি । ভয় পাবেন না আমি মানুষটা খারাপ নই —’
(ঐ আবার বকবক্ শুরু হলো । লোকটা এমনি ভালো । খুব ভালো ভালো কথা বলে । এতো সুন্দর কথা বলে কিন্তু এ জায়গায় কেন থাকেন । আশা করি খারাপ কিছু হবে না । না একটু কথা গুলো শোনা যাক । )
—‘—আপনি বিশ্বাস করবেন কিনা জানি না । আমি বাংলা সাহিত্যে স্নাতক পাশ । তারপর কিছু কারণে আমার এম এ টা করা হলো না । সেটা নিয়ে আমার দুঃখ নেই । জানেন আমি ছোটো থেকেই লেখালেখি করতাম । মা বলতেন ছোটো সুকান্ত । বাবা আবার এইসব পছন্দ করতেন না । যাই কলেজে উঠলাম । এই বাঁদিকটা দেখে , ম্যাডাম রাস্তার যা অবস্থা । হ্যাঁ তো কলেজে ভর্তি হলাম । দুবছর ভালোই রেজাল্ট হলো । কিন্তু কি জানেন তো , এখানে টাকার দাম আছে মানুষের প্রতিভার কদর নেই । জানেন কম জায়গায় ঘুরিনি , অনেক বড়ো ম্যাগাজিনের অফিসে গেলাম , বললো আমি নামি লেখক নই তাই আমার লেখা লোকে পড়বে না । ম্যাডাম এবার ডানদিকে বাঁকতে হবে । তারপর অনেক ছোটো ম্যাগাজিনের অফিসেও হত্যে দিয়েছি ফল , একই ছিল আরও বললো যে কিছু টাকা দিলে ওরা ভেবে দেখতে পারে । শেষমেষ আমার খুবই ভালো এক বন্ধু আমার লেখাটা নিল , বললো ও এই লেখাটা ছাপিয়ে দেবে । কিন্তু কিছুদিন পর ও এসে বললো যে লেখাটা ছাপাতে পারেনি , অনেক চেষ্টা করেও পারেনি । পরে দেখলাম আমার লেখাটা কপি করে ও নিজের নামে লেখা বার করেছে । তবে থেকে না নিজের লেখার ক্ষমতার ওপরই ঘেন্না এসে গেছে । এখানে মনের ভাসার কোনো মূল্যায়ন হয় কি ? ম্যাডাম সামনে রাস্তাটা এবড়ো-খেবড়ো সামলে আসবেন । ’
(আমরা মানুষরা বড্ড ভীতু । কারোর হেরে যাওয়ার ভয় , কারোর মরে যাওয়ার ভয় , কারোর পিছিয়ে পড়ার ভয় । তো এই ভয়ের কারণে কিনা জানি না । মানুষ নিজস্বতা হারিয়ে ফেলছে । আজ এই অচেনা একটি মানুষ অনেক কথা বলছেন । আর সত্যি খুব ভালো কথাগুলোই বলছে । তবুও কেন উনি এইরকম জায়গায়—)
—‘কই আসুন প্রায় এসেই গেছি । আর একটু এই ছোটো গলি ধরে সোজা এগোলেই আমার বাড়ি । আসুন আসুন আপনাকে তো আবার তাড়াতাড়ি ঘরে ফিরতে হবে । বাড়িতে কাউকে জানিয়ে এসেছেন তো মানে দেরি হলে—’
(বাড়ি ? আচ্ছা বাড়ি মানে কি । একটা ছাদ , চারটে দেওয়াল,আর কিছু মানুষ ? তাই কি ? কিন্তু আমার তো মনে হয় না । বাড়ি মানে বিরাট বড়ো একটা পরিবার , রাতের বেলা ঠাকুমার মুখে রূপকথার গল্প,উঠোনে ভাইবোনের ছুটে বেড়ানো, একসাথে বড়ো হওয়া , মোট কথা যেখানে মানুষ তাদের সম্পর্কগুলোকে প্রাণপণে টিকিয়ে রাখে । কিন্তু আমি ছোটবেলা থেকে এর কিছুই পেলাম না । ছোটো থেকেই আমি বাবা মা এর সাথে । তাই বোধহয় একসাথে থাকা কি বুঝবো—’
—‘আরে কি হলো চলুন , কি দেখছেন ? ও পঞ্চাকে ? ছোট বেলা থেকে বেচারা পিতৃহীন । মা লোকের বাড়ি কাজ করে । আর ও কখনো জুতো সেলাই করে কখনো পার্কে গিয়ে পেপসি আইস্ক্রীম্ বিক্রি করে । কিন্তু জানেন ম্যাডাম । এতো কিছুর মাঝেও পড়াশুনো করতে চায় , বড়ো হতে চায় । কিন্তু ঐ যে একটা জিনিস নেই ওর কাছে টাকা । স্কুলগুলোর কাছে শিক্ষার চেয়ে বড়ো টাকা নেওয়া আগে হয়ে গেছে । যাই হোক চলুন , এগোনো যাক ।’
—‘হ্যাঁ চলুন । ’
হঠাৎ ঠিক আমার পায়ের সামনে ,সিগারেটের জলন্ত ফিল্টারের অংশ টা সামনে এসে পড়লো । আমি কিছু বলার আগেই ,শীর্ষেন্দু দা চেঁচিয়ে উঠলো —
—‘কে বে শালা ? কাণ্ডজ্ঞান নেই । বোকাচোদা সালা । দাঁড়া পরে তোদের ব্যবস্থা করছি ।
—‘ছাড়ুন ছাড়ুন । ও কিছু না , আমার দেরি হয়ে যাচ্ছে ,চলুন এগোনো যাক। ’
—‘এখনকার মতো বেঁচে গেলি । পরে মজা দেখাচ্ছি শালা নেশাখোর গুলো । ’
বুঝলাম সিগারেট টা বাঁদিকের বাড়িটা থেকে কেউ ছুঁড়েছে । কিন্তু কি আর করা যাবে , এখন এই সব নিয়ে শুরু হলে সময় নষ্ট হবে । এগোতে গিয়ে শেষবার ঐ বাচ্চাটার দিকে তাকালাম । কেরকম অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে আমার দিকে । কি ভাবতে পারে বাচ্চাটা ?
( বাচ্চা ছেলে , কতই বা বয়স হবে , ১০ বছর ? এই রোদে আইসক্রীম বিক্রি করতে যাচ্ছে । ছেলেটা একবার শীর্ষেন্দুদা এর দিকে হাসলো । এই হাসিটা কিসের হাসি ? দেখো আমি সব কষ্ট সহ্য করার ক্ষমতা রাখি নাকি তোমরা পারবে আমার মতো হাসতে কিছু না পাওয়া সত্ত্বেও । আমরা কি এতটাই অসহায় যে একটা বাচ্চাকে সামান্য বর্ণপরিচয় পড়ানোর ক্ষমতা রাখি না ? অবশ্য পড়বে কেন পেট টাই যদি না চলে , পড়াশুনা থোড়ি হবে । একটা ১০ বছরের বাচ্চা , ঘুড়ি ওড়াবে,খেলাধুলা করবে কিন্তু তা না করে তাকে নিজের ঘাম বেচে ভবিষ্যৎ জলাঞ্জলি দিতে হচ্ছে । এই যে মানুষ গুলো রোজ প্যাকেট প্যাকেট বিড়ি , সিগারেট খায় এরা কি পারে না যে টাকায় ঐ ফালতু ধোঁয়া গিলে সময়কাটায় , ঐ টাকা জমালে হয়তো দুটো বাচ্চার পড়াশুনোর খরচ উঠে যাবে । হ্যাঁ , এর অজুহাতে বলবে হয়তো ‘ খুব চাপ ’ নয়তো ‘ প্রেমে কষ্ট ’ । আসলে ঐ লোক গুলোর জীবনটাই ধোঁযাশায় ঢাকা এদের জীবনটাই ধোঁয়ার কুন্ডলীর মধ্যে ঢাকা । তাই বাচ্চাটা স্বপ্নগুলোকে ধরার জন্য যুদ্ধ করছে আর তথাকথিত পরিণত বালক-বালিকা শুধু ধোঁয়া গিলে—’
—‘ম্যাডাম , আমরা পৌঁছে গেছি । এই হলো আমার ছোট বাড়ি …….
(ক্রমশ)