আমি তিতির ( তৃতীয় পর্ব )

(আমার নাম বোধহয় তিতির । আমার বয়স ১৯ । আমি ছোটো থেকে social anxiety disorder এর শিকার । আমি ভাবতে ভালোবাসি । আর এটা আমার গল্প । )

(কখনো কখনো মনে হয় আমাদের জীবনে সকালের চেয়ে রাতগুলো বেশি বড়ো । অবশ্য সেটা বিভিন্ন জনের কাছে বিভিন্ন ভাবে বড়ো হয় । যেমন ধরুন , রাস্তার ফুটপাতে শুয়ে থাকা মানুষগুলো , যাদের আমরা খুব সম্মান দিয়ে ফুটের লোক বা উদ্বাস্তু ও বলে থাকি , যাকগে সেটা বিষয় নয় আসল কথাটা হচ্ছে এদের কাছে রাতগুলো সাধারণত বড়োই হয় আবার ঐ একই রাত কোনো বড়ো বিলাশবহুল ফ্ল্যাটের এসি চালিত ঘরের বাসিন্দাদের কাছে রাত গুলো ছোটো হয় ,“ধুসস্ , এই তো সবে এসিটা অন করে ঘুমোলাম , এক্ষুনি সকাল হয়ে গেল !!!” । আর ফুটপাতের ধারে শুয়ে থাকা মানুষগুলো ভাবে কখন সকালটা হবে , “উফফ্ , যা ঠান্ডা পড়েছে আজকে ” কিংবা “তাড়াতাড়ি সকালটা হলে বাঁচি কি জানি আবার কোনো গাড়ি না ফুটপাতে উঠে এসে …..)

কিন্তু আমি এসব ভাবছি কেন ? আমার তো এগুলো নিয়ে ভাবার কথা নয় । আমার তো অন্য কিছু নিয়ে ভাবার কথা । আমি তো সকালে ডাঃ রায়ের কাছ থেকে বেরিয়ে যে ট্যাক্সিতে ফিরছিলাম সেটায় ব্যাগশুদ্ধু ডায়েরিটা ফেলে এসেছিলাম । এইতো ১ ঘন্টা আগেই ঐ ট্যাক্সিচালকের ফোন এসেছিলো তারপর একটা জায়গার নাম বললো ওখানে আসতে আমার জিনিসটা আমায় ফেরত দিয়ে দেবে । যখন শুনলাম আমার ডায়েরিটা ওনার কাছে , কিছুক্ষণ ভাবলাম মজা করছে নাতো ? কিন্তু তারপর যখন ঘরের মধ্যে কোথাও খুঁজে পেলাম না ,তখন মাথাটা ভোঁ ভোঁ করতে আরম্ভ করছিলো । তারপর বুঝলাম না , সত্যিই ফেলে এসেছিলাম । মা টাও না , মা তো পারতো খেয়াল করে ডায়েরিটা গুছিয়ে রাখতে । এখন আর কি ? যাও কাল সকালে ঐ একটা অজানা জায়গায় গিয়ে , অচেনা লোকের কাছ থেকে ডায়েরিটা ফেরত নিতে এসো। অবশ্য ভুলটা আমারই আমি যদি ডায়েরিতে নামের সাথে ঠিকানা টাও লিখে রাখতাম তাহলে ঐ ট্যাক্সিচালকটা কি যেন নামটা ,হ্যাঁ শীর্ষেন্দু দাস , উনিই এসে দিয়ে যেতেন । যাইহোক এখন ভাবছি একলা যাবো কিনা । চিনি না , জানি না , একলা যাওয়াটা কি ঠিক হবে ? মাকে বলা যাবে না মা কে বললে এখন আবার প্যান প্যান করে বকা শুরু করবে । তাই মা থেকে দুরে যা করার একাই করতে হবে । তাছাড়া ডাক্তারকাকুই তো বলেন “ নৌকো তোমার , মাঝিও তুমি , তুমি তোমার নৌকো কে ডোবাবে না ভাসাবে , its up to you.” আর হ্যাঁ , সত্যিই আজকের রাতটা যেন খুব বড়ো ।
পরের দিন সকালে ঘুম থেকে উঠলাম,দেখি ৯ টা বেজে গেছে । বাবা বোধহয় অফিসের জন্য বেরিয়ে গেছে । যাই হোক , দাঁত ব্রাশ্ করে , ফ্রেশ হয়ে break fast এর জন্য মা কে তাড়া দিতে লাগলাম —
—‘মা তাড়াতাড়ি break fast টা দাও , আমায় বেরোতে হবে । ’
—‘উফফফ্ ,দিচ্ছি মানুষ তো নাকি ,তাছাড়া তোর আবার কিসের তাড়া, আজ তো কলেজ ছুটি । ’
—‘আমি একটু পার্কে যাবো , কাজ আছে । ’
—‘আরে আস্তে খা ,পার্ক তো পালিয়ে যাচ্ছে না । সবটুকু শেষ করে উঠবি । ’
—‘পারছি না মা , দেরি হয়ে গেছে আসছি ,টাটা মা । ’
—‘দেখেছো,দেখেছো কিরকম মেয়ে খাবার নষ্ট করে । অ্যাই তিতির কি করতে যাচ্ছিস সেটা তো বল । আরে অ্যাই তিতির—’

উফফ্ । অনেক কষ্টে মা এর হাত থেকে ছাড়া পেলাম । আমাকে এখন তাড়াতাড়ি ঐ জায়গা টায় পোঁছতে হবে । ১১ টায় পৌঁছলাম জায়গাটায় । জায়গাটা একটা বস্তি এলাকা । লোক গিজগিজ করছে । ঠিক জায়গায় এলাম তো ? এতো লোক এখানে এইটুকু জায়গায় ? মাথাটা কেমন করতে লাগলো ,বড্ড ভয় ভয় করছে । ওষুধ গুলো সাথে রাখলে ভালো হতো । এমন সময় হঠাৎ পেছন থেকে মেয়েলি গলায় —
—‘এই যে শুনুন । ’
—‘ হ্যাঁ ব-বললুন । ’
—‘আপনি কি কাউকে খুঁজছেন ?’
—‘হ্যাঁ, ঐ শীর্ষেন্দু দাস নামের —’
—‘আমিই শীর্ষেন্দু দাস ।’
—‘নমস্কার , আমি তিতির । আমার ব্যাগ আর ডায়েরিটা এনেছেন ?’
—‘না , আসলে আমায় সকালে একটু কাজে বেরোতে হয়েছিলো । তো আনতে পারিনি । আপনি আমার সাথে আমার বাড়ি চলুন , বেশি নয় ১০ মিনিট লাগবে যেতে । তাছাড়া আমাকেও তো সেই বাড়ি যেতে হচ্ছে । বস্তি এলাকায় থাকলেও আমরা আতিথেওতা করতে জানি ।
—‘না , মানে । ’
(আচ্ছা ঝামেলায় পড়া গেল তো । এখন কি করি ? লোকটা সুবিধের কিনা তাও তো বুঝছি না । মা কে একবার ফোন করবো ? না থাক গিয়েই দেখি কি হয় ? তাছাড়া অনেকদিনের ইচ্ছে ছিলো , বস্তির মানুষগুলো কেমন জীবন কাটায় )
—‘–ম্যাডাম , ভয় পাবেন না । আপনার কোনো ভয় নেই । কোনো ক্ষতি করবোনা আপনার । আমাকে দাদার মতো ভাবতে পারেন । আমরা বস্তির মানুষগুলো গরিব , নোংরা ,অশিক্ষিত হতে পারি কিন্তু নির্লজ্জ নই যে রাত্রিবেলা বার বা পাব থেকে মদ খেয়ে , রাস্তায় ওপেন মেয়দের সাথে“——-” করবো বা মাতাল হয়ে ফুটপাতে গাড়ি চালিয়ে কেতবাজি মারবো । যদিওবা বার , পাব , গাড়ি এগুলো আমাদের কাছে সাতরাজার ধন তবুও আমাদের এসব কিছু চাইনা । আমরা ডালভাত , আর ছোটো ছোটো খুশিগুলোতেই খুব ভালো আছি । তাই—’

(অ্যাঁ , লোকটা বলে কি ? না প্রশ্ন এটা না হয়ে বরং হওয়া উচিৎ লোকটা এই কথাগুলো বলছে কি করে ?— না এটাও ঠিক না । এইরকম জায়গায় দাঁড়িয়ে বা এরকম জায়গায় বসবাস করে এমন লোক , এতো ভালো , শুধু ভালো বলা ভুল বাস্তবিক কথা পরিস্কার বাংলায় বলছে কি করে ? তাহলে কি আমরা , মানে তথাকথিত ভদ্র সমাজ , ভুলে গেছি যে — বস্তি নামক একটি দলিত জায়গায় মানুষরাই বাস করে ? নাকি এটা ভুলে গেছি যে পদ্মফুলটাও কিন্তু পাঁকেও জন্মায় ? না মন দিয়ে শুনতে হবে আর কি বলেন । ডায়েরিতে লিখতে , খুব ভালো কথা বলেন তো—)

—‘সরি, সরি আমি একটু বেশি বলে ফেলেছি , আসলে flow তে চলে এসেছিলাম , পুরোনো অভ্যাস । সে যাই হোক আপনার যদি অসুবিধা থাকে আপনি এখানে অপেক্ষা করতে পারেন । আমি যাবো আর আসবো । ’
—‘না ,না ঠিক আছে চলুন । আমার কোনো অসুবিধা নেই । ’

(ফোন তো আছে । সেরকম হলে মা কে ফোন করে দেবো । কিন্তু কিছু হলে ফোন করার সময় পাবো তো ? সত্যি আমিও না , ঐ যে তথাকথিত ভদ্রসমাজ , এতো কিছুর পরেও আমরা এইসব মানুষদের সন্দেহ করতে ছাড়ি না । যদিওবা সন্দেহ করাটা জন্মগত —)
—‘কঈ ম্যাডাম আসুন । যাবেন যে , এই ডানদিক দিয়ে আসুন , হ্যাঁ একটু দেখে , রাস্তাঘাট তো আর বললামই না । হেঁ,হেঁ,নির্মল গ্রাম মিশন চালু হলেও নির্মল বস্তি মিশনটা এখনো সরকারের মাথায় আসেনি তো । আসলে বস্তি এলাকার কথা লোকের মাথায় তখন আসে যখন বস্তিতে আগুন লাগার খবর , কোনো স্বামী হয়তো তার স্ত্রীকে বেধড়ক পিটিয়েছে বা ভোটের সময় কেউ পুলিশকে পেটো বা আধলা ইঁট ছুঁড়েছে —এইসব ঘটনা টিভি চ্যানেলের হেডলাইন হয় । নাহলে , এই বাঁদিক টা দেখে । হ্যাঁ , আসুন এইদিকে—’

(ক্রমশ)

(“ “সবাইকে জানাই শুভ নববর্ষের আন্তরিক ভালোবাসা , শুভেচ্ছা আর প্রণাম । নতুন বছর সবার খুব খুব ভালো কাটুক । আর আজকের দিনটা অন্তত বিরিয়ানী , চিলি চিকেন ছেড়ে ডালভাত , মাছ আর পাঁচমেশালি তরকারিতে shift করুন , ভালো লাগবে ” ”)

Facebook Comments Box

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *