কৃপণ

কৃপণ

আমাদের পাড়ার অজিত জ্যেঠু অঙ্কের শিক্ষক, পাড়ায় তিনি অজিত মাস্টার নামেই পরিচিত।
মানুষটা খুব কম কথা বলেন, পাড়ায় তার কোনো ঘনিষ্ঠ বন্ধুও দেখিনি। সবাই বলে অজিত মাস্টার খুব গা বাঁচিয়ে চলে, লোকের সাথে মিশলে তাকে তো কোনদিন চা, বিস্কুট খাওয়াতে হতে পারে; সেই ভয়েই মেশেন না কারোর সাথে।
তবে বাড়ির বড়োদের থেকে শুনেছি তিনি আগে এরকম ছিলেন না। বিয়ের কয়েক বছর পর তাঁর স্ত্রী-এর ডেলিভারির সময় স্ত্রী সন্তান দুজনকেই এক সাথে হারান। তা প্রায় বছর ২০ আগের ঘটনা।
বিয়েও করেননি আর, বৃদ্ধা মাকে নিয়ে এই পাড়াতেই থেকে গেছেন, তারপর থেকেই নাকি মানুষটা আর আগের মতো নেই।

(দুই)

অজিত মাস্টারের সবচেয়ে চোখে পড়ার মতো বিষয় তার কৃপণতা, পাড়ার বড় থেকে ছোট কারোর অজানা নয় তার কৃপনতার কথা।
পাড়ায় দুর্গাপূজোয় যখন সব বাড়ি থেকে ১০০০ টাকা চাঁদা ধরা হয়, তখন অজিত জ্যেঠু ২০০ টাকা হাতে ধরান প্রত্যেক বছর। এমনকি মানুষটাকে পুজোয় কোনদিন নতুন জামাও পড়তে দেখিনি। তার কাছে পূজোর বাজার মানে মা এবং দিদির জন্য শাড়ি কেনা এতটুকুই।
অজিত জ্যেঠুর সাথে যারা স্কুলে চাকরি করে তাদের প্রায় সকলেরই দেখেছি মোটরবাইক আছে, কয়েকজনের চার চাকাও আছে ব্যাতিক্রম শুধু অজিত মাস্টার… মান্ধাতার আমলের সাইকেলটা নিয়েই তিনি স্কুল যান এবং বাড়ি আসেন।
পাড়ার ঘোষ থেকে সব্জিওয়ালা সবার সাথেই তার দাম নিয়ে সকাল বিকেল ঝামেলা লাগে। এইজন্য অনেকেই তাকে হাড়কিপ্টেও বলে, পাড়ার চায়ের দোকানের আড্ডা থেকে ক্যারামের ঠেক সব জায়গায় হাসির পাত্র অজিত মাস্টার।
এইতো সেদিন সুজয় বলে উঠল, ‘দেখিস অজিত মাস্টার সেদিন বাইক কিনবে, যেদিন পেট্রোলের জায়গায় জল দিয়ে বাইক চলবে।’
রোজ দেখতাম ঠিক সকাল ন’টায় অজিত মাস্টার স্কুলের দিকে রওনা দিতেন আর বিকেলের পর ফিরতেন, মাঝে মাঝে খেয়াল করতাম অনেক রাত করেও ফিরছেন। যখন আমরা আড্ডা দিয়ে বাড়ি ফিরতাম তখন অজিত মাস্টারের ভাঙা সাইকেল নিয়ে এগিয়ে আসার আওয়াজ পেতাম।

(তিন)

সেদিন সকালে হটাৎ খবর পেলাম অজিত মাস্টারের অ্যাক্সিডেণ্ট হয়েছে, একটা দ্রুতগতিতে আসা মোটরবাইক সামনে থেকে মেরে পালিয়েছে। অবস্থা ভালো না, কান দিয়ে রক্ত বেরিয়েছে অনেক।
একটু বেলার দিকে যখন পাড়ায় বসে আড্ডা দিচ্ছিলাম তখন খবর পেলাম অজিত জ্যেঠু মারা গেছেন, অবাক হয়েছিলাম খবরটা শুনে। মানুষটা এইভাবে হঠাৎ করে চলে গেলো!
দুপুরে যখন ডেডবডিটা দেখতে অজিত জ্যেঠুর বাড়ি গেলাম, দেখলাম ডেড্ বডিটা ঘিরে বসে আছে প্রায় শ-খানেক বাচ্চা, সবার চোখে জল, আর একজন আমাদের বয়সি ছেলে বাচ্চাগুলোকে শান্ত করতে ব্যস্ত।
মনে অনেক প্রশ্ন জেগেছিল, এরা কারা? তারপর যা শুনলাম তাতে কিছুক্ষণের জন্য নিজেকে আত্মগ্লানিতে মেরে ফেলতে ইচ্ছে করছিল।
এগুলো সব অনাথ বাচ্চা, অজিত মাস্টার শুধু স্কুলের শিক্ষকই ছিলেন না তিনি একটা N.G.O. চালাতেন আর এই শিশু গুলো সেখানকারই। তার স্কুলের পাশেই যে অনাথ আশ্রম, সেটা অজিত মাস্টারই চালাতেন। স্কুল শেষে ওদের সঙ্গেই সময় কাটানো, তাদের পড়ানো ইত্যাদিগুলো অজিত মাস্টারই করতেন।
বাচ্চাগুলোর কান্না দেখে ভেতরটা পুড়ে যাচ্ছিল, মৃত্যু সংবাদ পেয়েও ওরকম কষ্ট হয়নি যতটা ওদের অশ্রুভেজা মুখগুলো দেখে হচ্ছিল।
অজিত মাস্টার প্রায় ২০ লাখ টাকা জমিয়েছেন এই শিশু গুলোর ভবিষ্যতের জন্য।
যে মানুষটা-কে নিয়ে গোটা পাড়া মজা-তামাশা করতো, তার চলে যাবার দিনে গোটা পাড়া চোখের জল ফেলছে।

হ্যাঁ, অজিত মাস্টার আর নেই, তবে তিনি না থেকেও রেখে গেছেন শ-খানেক শিশুর ভবিষ্যৎ, আর দিয়ে গেছেন চোখে আঙুল দিয়ে একটা জ্বলন্ত শিক্ষা।

সমাপ্ত।

Facebook Comments Box

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *