কোনো এক মাদারি ( দ্বিতীয় পর্ব )

(১)

—‘হ্যালো, সৌম্য জলদি রেডি হয়ে পার্কে আয় ।documentery এর জন্য ভালো subject পেয়েছি । আর ঘুমোসনা , তাড়াতাড়ি চলে আয় , আমি রাখলাম।’
ফোনটা রেখে আমি কিছুক্ষণ চুপচাপ বসে থাকলাম । উঠে বসে চোখ কচলাতে কচলাতে ঘড়ির দিকে তাকালাম , অনেকটাই সকাল হয়ে গেছে । আমার মা মারা গেছে যখন , আমার ১০ বছর বয়স । তারপর থেকে আমায় আমার বাবা কোলেপিঠে মানুষ করেছেন । কিন্তু আমি বোধহয় খারাপ ভাগ্য করেই জন্মেছি আমার বাবাও দুবছর হলো মারা গেছেন । বাবা সব সময় চেয়েছিলেন আমি কিছু করি , অনেক বড়ো হই । তখন আমি কলেজে ফার্স্ট ইয়ারে , যেরমটা হয় প্রথমে প্রেম , তারপর কিছুদিন পর ছাড়াছাড়ি , একটা simple sad story । কিন্তু তখন ১৯ বছরের ছেলের কাছে ব্যাপারটা গুরুতর । খাওয়াদাওয়া ছেড়ে দিলাম , একলা একলা থাকতাম । তখন বাবাই আমাকে একটা কথা বলেছিল ,“ তুমি খুঁজলে ১০টা love story খুঁজে পাবে কিন্তু মানুষের মতো মানুষ হওয়ার কাহিনী , বুক চিতিয়ে লড়াই করার কাহিনী কিংবা হাল না ছাড়ার কাহিনী খুঁজে পাবেনা কারণ এগুলোর কাহিনী হয় না , এগুলো বাস্তব……..” । যা অনেকটা দেরি হয়ে গেল এবার বেরোতে হবে । ঈশান অপেক্ষা করছে।

(২)

—‘কি ভাই এতো দেরি ? কখন থেকে দাঁড়িয়ে আছি জানিস ।’
আমি কিছুক্ষণ চুপ করে থাকার পর বললাম
—‘সরি রে , ঈশান ঐ একটু—’
—‘থাক বুঝেছি । মোদ্দা কথায় আসা যাক , আমি আমাদের documentery এর জন্য সাবজেক্ট খুজে পেয়েছি ।’
—‘কি সাবজেক্ট ?’
আজকের খবরের কাগজটা আমার হাতে ধরিয়ে বললো
—‘একদম ভেতরের পাতায় , উপরের দিকে মাঝারি মাপের লেখাটা পড় ।’
—‘চুরির সন্দেহে মাদারির খেলা দেখিয়ের মেয়েকে পিটিয়ে খুন । ’
পুরোটা একসঙ্গে পড়লাম । সত্যি দুনিয়াটা অদ্ভুত । নিজের থেকে দুর্বল যদি কাউকে পেয়েছো তো তার সাথে যা খুশি তাই করে নাও ।
—‘প্ল্যান টা কি ? ’
—‘দ্যাখ,তুই হয়তো জানিস যে বাঁদরের খেলা দেখানো টা বহু পুরোনো একটা সার্কাস টাইপ জিনিস । এখন প্রায় লুপ্ত হতে বসেছে । আমার মনে যেহেতু সার্কাসটা বাঙালির রক্তে , জানিসই তো প্রফেসর প্রিয়নাথ বসুই প্রথম বাঙালির মধ্যে সার্কাসের craze নিয়ে আসেন the great bengal circus এর মাধ্যমে । তো আমরা যদি তুলে ধরতে পারি যে বাঁদরের খেলা দেখানোটাও একটা সার্কাস । এটা আরো পাবলিক রিলেটেড ,মানে স্ট্রীট সার্কাস শো টাইপ । এটার থেকেও মেন ব্যাপার হলো মেয়েটাকে মরতে হলো কেন ? তার বাবা এখন কি করছে ? আরও অনেক জট ছাড়াতে হবে ।’
এতো পর্যন্ত বলে একটু ঈশান থামলো ।
—‘তারপর ।দ্যাখ যেহেতু documentery বানাচ্ছি আমরা তো তার জন্য একটু পড়াশুনো করতে হবে , সেটা মাথায় আছে তো ? ’
—‘নো চাপ brother । আমি পড়াশুনো করেই এই জিনিস টা করার জন্যপা বাড়িয়েছি । তো তোকেও বলছি শোন । প্রথমেই বলি রাখি মাদারি মানে কিন্তু বাঁদরের খেলা দেখিয়ে নয় , মাদারি হলো উত্তর ভারতের মুসলিম ফকির সম্প্রদায় যাদের তামিলনাড়ুতে বলা হয় arunthathiyar । ভারতে বেশিরভাগ বাঁদরের খেলা প্রথম এই সম্প্রদায়ের মানুষের হাতে ঢোকে । তো সেই থেকে এখানে এদের নাম মাদারি । ১৯৭৩ wildlife protection act অনুযায়ী ভারতে এই খেলা দেখানো বেআইনি । প্রায় পৃথিবীর সব জায়গায় একই অবস্থা । তবে একমাত্র জাকার্তায় এই খেলা দেখানো বেআইনি নয় । এবার আসি কিভাবে বাঁদর খেলা দেখানো শুরু হলো । ১৮ এর দশকে ইউরোপে কিছু স্ট্রীট performer এলো , যারা রাস্তায় গান গাইতো , গল্প শোনাতো , এদেরকে বলা হয় organ grinders । তো এরা করলো কি আরো দর্শক টানার জন্য এদের গানের তালে তালে নাচার জন্য ছোট ছোট বাঁদরদের নিয়ে আসতে শুরু করলো । ১৯৩৫ সালে ইউরোপে বাঁদরের খেলা দেখানো বন্ধ হয়ে যায় । তারপর ধীরে ধীরে এই খেলা পূর্ব এশিয়ায় ঢোকা শুরু হয় । এই হলো আমার পড়াশুনো । আর বকবক করতে পারছি না , কাল সকালের ট্রেন , রেডি থাকিস ।’
—‘হমমম্, চল । আকাশে মেঘ করেছে । বৃষ্টি শুরুর আগে ঘরে ঢুকতে হবে । ’

( ৩ )

অনেকক্ষণ হলো বৃষ্টি শুরু হয়েছে । নাশিম শুকনো চোখে বাড়ির দাওয়ায় বসে আছে । পোষা বানর ভজুয়া টাও বারান্দার এক কোণে মুখ নীচু করে দাঁড়িয়ে আছে । চোর সন্দেহের জন্য এতো বড়ো শাস্তি ? হে আল্লা । আমায় মেরে দিতে পারতে । ঐটুকু মেয়েটার কি দোষ ? সবকিছুর মূলে এই বান্দরের খেলা । এর সব কিছু শেষ করতে হবে । ঐ ভজুয়াটাকেও বাঁচিয়ে রেখে লাভ কি ? ওকেও মেরে ………..

(ক্রমশ )

Facebook Comments Box

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *