কলকাতার বাড়িটা ও পাঁচজন

আকাশ হঠাৎ ঢাকলো মেঘে পায়রাগুলো ফিরছে ঘরে শতাব্দী প্রাচীন বাড়িটা একা কলকাতার ফুটপাথ ধরে, দাড়িয়ে আছে।

বৃষ্টি নামবে
জোর ঠান্ডায় গুটিশুটি মেরে চাদর গায়ে
বাড়ির রকে
পাগলা অ্যাংলো চোখ বুজে
অনবরত প্রলাপ বকে।
পথচারী কেউ হয়তো আড়চোখে দেখে মুখ ঘুরিয়ে চলে যায়।
কেউ বা মোবাইল কানে, না তাকিয়েই
পা চালিয়ে রাস্তা পেরোয়।

শতাব্দীপ্রাচীন বাড়িটা কেবল
কষ্ট হলেও দাড়িয়ে ঠায়
পাগলা অ্যাংলোকে যথাসম্ভব
ইট-পাঁজর দিয়ে আগলায়।

শীতের বেলা, পাঁচটায় অন্ধকার
তার উপর মেঘের আনাগোনা
উত্তরের ঝুল বারান্দায় দাড়িয়ে বৃদ্ধা
হিসেব করে; চোখ বোজার দিনগোনা।

বাড়িটা’র মাঝখানটায়, মাঝারি চাতাল
আগে পরিষ্কার করা হত রোজ। এখন সবাই ব্যস্ত।
কেউ শহরের একোণ-ওকোণে ছড়িয়ে
কেউ পরলোকে কেউ বিছানায় অসুস্থ।

চাতাল কোণে, পঞ্চাশে পোতা ক্যাকটাসটা
আজও বাড়ছে। বিশাল আকার ।
এ গাছের নাকি খুব গোঁয়া, অনেক উঁচুতে ওঠা চাই।
বৃদ্ধা দেখে নিথর চোখে
না, সেই আগের দিন আর নেই
সবসময়ই সবকিছু ঘোলাটে লাগে।

তিনতলার আঁধার ঘরে, হেমন্ত
পাথর চোখে তাকিয়ে থাকে
দেওয়াল জোড়া ছড়িয়ে রাখা
হলুদ পাতার বইয়ের তাকে।
শব্দগুলো ভাসে আজও,
ভাসে কুয়াশা ঢাকা রাত আকাশে,
শুধু কালো চশমা দিয়ে
পড়া যায়না কি লেখা পাতার শেষে।

ওপাশের আরেকটা ঘরে
দিনরাত রেডিওয় গান চলে
দরজাটা কিঞ্চিত ফাঁক করে রাখা।
তিরিশ পেরোনো মাস্টার্স শেষে
দেড়শো ভাড়ায় একুশ শতকে
শহরের এককামরায় বেঁচে থাকা।

সাতসকালে দু-চারজন পড়তে আসে ওর কাছে।
সাইকেল পিঠে ব্যাগ।
তখন কেবল গান বন্ধ হয়।

দশটায় ফের গান চালু।

এই দু-ঘন্টা পাগলা অ্যাংলো
সজাগ হয়ে বসে সাইকেল পাহাড়া দেয়।

আলোর বেলা ফুরিয়ে এলো
রাস্তায় অফিস ফেরতার কোলাহল।
জানালার শিক ধরে অনিন্দিতা
আকাশ দেখে। দেখে স্তব্ধ, নিরেট বাদল।
ডিসেম্বরে বৃষ্টি হয় প্রতিবার।
বাড়িটার গায়ে অসংখ্য চুমু লেপে
একদিন হঠাৎ মিঠে রোদ, সোয়েটার
গায়ে উঁকি দেয় খয়েরীর ধ্বংসস্তূপে।

বাড়িটা চুপ। চাতালটা স্যাঁতসেঁতে হয়ে থাকে।
ক্যাকটাসটা আরো উঁচুতে ওঠার সংকল্প নিয়ে
মাটি ফুঁড়ে আরো গভীরে ছড়িয়ে পড়ে।

অনিন্দিতা দেখে সবকিছু।
জানালার শিক ধরে, বিনা কাপড়ে
দাড়িয়ে থাকে। খুব ভেজে প্রতি
ডিসেম্বরে শীতবৃষ্টিতে।

ইতি:

সবাই সবাইকে দেখে
কিন্তু কেউ কারুর খোঁজ নেয়না।
নিথর মৃতদেহের মতো, এঘর থেকে
ওঘর সকলের নিত্য যাওয়া আসা,
তবু কথা কেউ বলেনা।

হেমন্ত রোজ একই ভাবে তাকিয়ে থাকে
আর কোনোদিন পড়তে না পারা বইয়ের তাকে।
বৃদ্ধাও প্রতি বিকেলে ঝুলবারান্দায় দাড়িয়ে থাকে।
সব ঝাপসা দেখায় নিভে আসা চোখে।
বেকার, তিরিশ পেরোনো চাকরির আসা ছেড়ে,
শতাব্দী প্রাচীন বাড়িটা’র এককামরার ঘরে,
সারাদিন রেডিওয় গান চালিয়ে রাখে।
পাগলা অ্যাঙলো বেঁচে থাকতে এই বাড়িটা সে ছাড়বে না।
হাড়হীম শীতেও রক আঁকড়ে পড়ে থাকবে।

সবাই এভাবেই বাঁচে।
ভিড়ের মাঝে দু-চারটে ক্যাকটাস অবশ্য থাকে।
তবে কেউ কারুর খোঁজ রাখেনা।
শতাব্দী প্রাচীন বাড়িটা একা এখোনো
কোলকাতার ফুটপাথ ধরে দাড়িয়ে আগলায়,
ছড়ানো কিছু জীবন।
বাড়িটার খবর কিন্ত ওই পাঁচজন রাখেনা।

এটাও পড়তে পারেন: ভাষা ও রঙ

বাড়িটা’র খবর রাখে কেবল কোলকাতার
সুট-টাই পরা একদল প্রোমোটার ।

Facebook Comments Box

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *