মা এর খুব সখ ছিল ঘুঙুর পরে নাচ করার। নাচ নিয়েই এগিয়ে যাওয়ার। কিন্তু বাড়ির বাবা, জেঠা এবং অন্য আরও বয়স্কদের গোড়ামীর জন্য সে সব কিছুই আর হয়ে ওঠেনি কোনোদিনও। তাই একটা সুপ্ত আশা মায়ের মধ্যে চিরকালই থেকে গিয়েছিল।
আমিও ছোটোবেলা থেকেই নাচটা বড্ডো ভালবাসতাম। একদম মায়ের মতো। মা এর ছোটোবেলার ঘুঙুরটা পরে আমিও নাচ করতাম। তাই মা ছোটোবেলায় আমাকেও নাচে ভর্তি করে দেয়। তাছাড়া বাড়িতে ঠাম্মা, দাদুন ও বাবার ও সম্মতি ছিল।
আমিও ভাবতাম বড়ো হয়ে নাচ নিয়েই এগিয়ে যাবো। একটা অদ্ভুত নেশা ছিল নাচ আমার কাছে। আসতে আসতে বড়ো হওয়ার সাথে সাথে পড়াশোনার চাপ বাড়তে থাকলো। বাবা অনেকবার বলেছিল নাচ ছেরে দিতে, কিন্তু আমি পারিনি। মায়েরও সম্মতি ছিলনা তাই হয়তো আমি আরো সাহস পেয়েছিলাম।
এটাও পড়তে পারেন – সেন-শর্মা
তখন ক্লাস নাইন, বার্ষিক পরীক্ষায় অঙ্কের নম্বর একদমই ভালো ছিলনা। তাই পড়াশোনার ক্ষতি হচ্ছে মনে করে বাবা রাগ করে আমার ঘুঙুর জোড়া বাইরে ফেলে দিল। মা তখন কিছু বলতে পারিনি বাবাকে। আমিও কিছু বলিনি তখন। নাচের ক্লাস বন্ধ, প্র্যাকটিস বন্ধ এসবের মাঝে দম বন্ধ হয়ে আসছিল আমার।
একদিন বাগানে ঘুরতে ঘুরতে হঠাৎ সেই ঘুঙুর জোড়া দেখতে পাই। বাবা যেটা বাইরে ফেলে দিয়েছিল সেদিন। ওটা পেয়ে সেদিন বড্ডো খুশি হয়েছিলাম আমি। ওই ঘুঙুর জোড়া মাদকের মতো ছন্দে মাতাল করে রাখত আমাকে। সেদিন থেকেই শুরু হয় আমার নতুন করে বাঁচা।
ঘরে একা একাই নাচ করতাম আমি। ঘুঙুর টাও পড়তাম না, ভয় হতো যদি কেউ জানতে পেরে যায়। পড়াশোনাও সমান তালে করতাম যাতে বাবা কখনো বুঝতে না পারে আমি পড়াশোনায় অবহেলা করছি। এভাবেই কাটলো আরো কয়েকটা বছর। স্কুলের গন্ডি পেরোলাম। রোজ কলেজে যাওয়ার নাম করে একটা নতুন নাচের স্কুলে ভর্তি হলাম। মা কে বলেছিলাম তখন সবটা। কলেজের যেকোনো অনুষ্ঠানে নাচ করতাম। এভাবেই একদিন একটা অনুষ্ঠানের বিচারকমন্ডলির মধ্যে থেকে একজন আমায় সুযোগ করে দেয় দেশব্যাপী একটি নৃত্য প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণের জন্য। সেদিনও বাবা আমার নাচের বিষয় সম্মতি জানাইনি। মা এর জোর করায় বাবা একরকম বাধ্য হয়েই রাজি হয়েছিল।
আজ শুধুমাত্র এই নাচের জন্যই আমি পরিচিত। নেশা থেকে পেশায় পরিণত হয়েছে আমার নাচ। আজ বাবাও আমার নাচের জন্য গর্বিত। আর সেই ঘুঙুর জোড়া, ওটা বাবা সেদিন ফেলে না দিলে হয়তো এসব কিছুই আজ হতো না। আমি নিতান্তই আর পাঁচজনের মতো সাধারণ হয়েই থেকে যেতাম আমি।