ইতিকথা কলকাতার মেয়ে, এই কলকাতা শহরে ও ওর জীবনের গোটা তেইশ বছর কাটিয়ে ফেলেছে, বাকি আর সবার মতোই ও নিজেও এই শহরটাকে ভীষণ ভালোবাসে, তবে বাকি সবার থেকে ওর তফাৎ যদি খুঁজতেই হয় তবে আমাদের ওর ভিতরে ঢুকে..ওর ভিতরটাকে বোঝা দরকার।
ছোটবেলা থেকেই ও বাড়ির সকলের ভালোবাসা পেয়েই বড়ো হয়েছে, কোনো কিছুর অভাব ওকে কখনই দেখতে হয়নি, তবে রয়ে গেছে শুধু একটা জায়গায় খামতি, ওর হাইটটা ৪.১০, যথেষ্ট কম, ও নিজেও জানে কিন্তু ও কোনোদিন গায়ে লাগায়না সেই ভাবে।
শহর কলকাতা অনেক আধুনিক, শিক্ষায় ভরপুর, তবুও এই শহরটাই হোক আর গোটা বিশ্ব,কালো,মোটা,খাটো এই শব্দ গুলো দিয়ে এখনও মানুষদের শারীরিক গঠনই শুধু মাপা হয় না,তার চেয়েও বেশি যা করা হয় তা হল,ব্যাঙ্গ।
স্কুলে প্রায় সবার মুখেই শুনতে হত ওকে,
“এই ইতি,তোকে দেখে না মনেই হয় না তুই ১২-এ পড়িস”
হ্যাঁ,ওর তখন বলা উচিত ছিল-
“তোকেও দেখে মনে হয় না রে যে তুই জীবনে এতটাই ফ্রী যে সব ছেড়ে আমাকে নিয়ে ভাবছিস”
তবে ইতিকথা কোনো উত্তর তখন দিতে পারতো না,
ও কিন্তু ভুলেও যায়নি যে ওকে কে কখন কি বলেছে,ও যে সব মনে রেখেছে তা কিন্তু ওই মানুষগুলোকে একদিন উত্তর দেবে বলে নয়,ও জানে যে শব্দ জিনিসটা অনেক দামি,সবার প্রতি খরচ করতে নেই।
একদিন ইতি ফেসবুকে একটা ছবি আপলোড করে,সেই ছবিতে ওর তখনকার প্রেমিকের এক বন্ধু কমেন্ট করে,
লেখে- “নাটকি”
সেদিন ইথিকথা থেমে যায়, কষ্ট পায় তবে ওই বন্ধুটির কমেন্টের জন্য নয়, নিজেকে এতটাই কমদামি করে ফেলার জন্য যাতে যে-কেউ যা-খুশি বলার ক্ষমতা পেয়েছে,সেদিন ও বুঝতে পারে নিজের চারিপাশে একটা দেয়াল তৈরী করে রাখা খুব প্রয়োজন, যাতে করে এটা স্পষ্ট হয়ে থাকে যে, যে-কেউ তোমায় জানার,চেনার এবং তোমার সাথে কথা বলার যোগ্যতা রাখে না।
এখন ও জানে যে ওর হাইট কত সেটা কখনোই ঠিক করে দেবে না ওর উচ্চতা ঠিক কতটা হবে বা ও কতদূর পৌঁছবে।
আজ ইতিকথা অনেকেটা বড়ো,ইংরেজি সাহিত্যে মাস্টার্স করছে,ওর আগেকার জীবনের মতোই চলছে ওর এখনকার জীবন,পার্থক্য শুধু একটাই, ও এখন উত্তর দিতে জানে, শিখেছে।
এখন যখন ওকে কেউ বলে –
ইসস তুই যদি আরেকটু লম্বা হতিস।
ও বলে – আপনিও দাদা যদি একটু শিক্ষিত হতেন।
শিক্ষা মানে ইতিকথা এখন বুঝেছে,পিএইচডি করা একটি লোকও অশিক্ষিত হতে পারে,যদি তার মানুষিকতা ছোট হয়।
“তোমাকে দেখে মনে হয় এখনো স্কুলে পড়ো”
এসব কথাতে ও এখন হাসে,শুধু মুখে নয়,মনে মনেও।
ও নিজে কখনোই কাউকে তাদের কমতি গুলো ধরিয়ে দেয় না,ও জানে কমতি যদি থাকে তবে সেটা শুধুই মানুষিকতার,শিক্ষা মানুষকে উন্নত করে,মানুষকে বুঝতে শেখায় যে,কোনো মানুষকে ছোট করা কখনোই কোনো মানুষের কাজ নয়। খারাপ মানুষ নাকি ভালো মানুষ তার প্রশ্নই আসছে না।
ইথিকথা লিখতে ভালোবাসে, ভালো লেখে নাকি খারাপ সেসব নিয়ে ও মাথা ঘামায় না, ও জানে কোনো বই যেমন খারাপ হয় না তেমনি লেখাও তাই। সমালোচনা, ব্যাঙ্গ এসব নিয়ে ও বিন্দুমাত্রও চিন্তিত হয়নি কখনোই।
ওর ইউনিভার্সিটির পেজে, ওর একটা লেখা ছাপা হলো একদিন-
“তুমি আর আমি এক নই
তুমি মানুষকে তার বাহ্যিক বিবরণ দিয়ে বিচার করো…আমি মানুষগুলোর ভিতরটা খুঁজি,
তুমি সুন্দর জিনিস গুলোর মধ্যেও অসুন্দরকে খোঁজো…আর আমি প্রথম থেকেই জানি যে সব অন্ধকারেই একদিন আলো ফুটে উঠবে,
তুমি ভাবো যে একা কোনো জীবন হয় না,বন্ধু-বান্ধব প্রয়োজন,আমি ভাবি নিজের মতন সত্যি বন্ধু আর কটা?
তুমি মানুষকে কষ্ট দিয়ে ভুলেই যাও..আমি ভাবি ‘কথাটায় বোধহয় কষ্ট পেল,না বললেই পারতাম’
এমন অনেক তুমিই আছো যারা মানুষকে কটা কটু কথা বলে ভাবো,কোনো রাজ্য জয় করে ফেললে।
“এই তুই এতো কালো কেনো রে?” “ইসস আরেকটু যদি লম্বা হতিস” এরকম বলাটা আর মানুষের চোখে ছোটো হয়ে যাওয়াটা খুব সহজ, তার চেয়ে বরং আমি যখন বলি,”শিক্ষার উচ্চতাটা তোর আছে,আর কিচ্ছু লাগবে না”..আমার মতে আমি একদম ঠিক করি।
ভগবান মানবজন্ম দিয়েছে,বেকার সবার চোখে পশু হয়ে থেকে কি লাভ?মানুষদের সুখ দেওয়ার মতন সুখ কিচ্ছুতে নেই।
তবে ওই যে…তুমি আর আমি এক নই। ভাগ্যিস।”
-ইতিকথা
ওর এখন একটাই স্বপ্ন,ও চায় এমন একটা পৃথিবী, যেখানে মানুষেদেরকে তাদের বাইরের আবরণ দিয়ে বিচার করা হবে না,যদি বিচার করতেই হয় তবে মানুষদের তাদের চরিত্র দিয়ে বিচার করা হোক।ওর আর বাকি অনেকএর মধ্যে এই একটাই পার্থক্য, ও জানে,’যে সয় সে রয়’-এটা এখন বিলুপ্ত, বাঁচাতে হলে সহ্য করতে নেই,যদি থাকতে হয় তবে বুঝিয়ে দিতে হবে গোটা পৃথিবীকে যে আমি খাটো হতে পারি তবে আমাকে পা দিয়ে পাড়িয়ে চলে যাওয়া যাবে না কখনই।