আচ্ছা আমরা যারা বাঙালি, মানে সত্যিকারের বাঙালি,আমরা বোধহয় একটা জিনিসে খুব বিশ্বাস করি,আর সেটা হল গায়ে কাঁটা দেওয়া । তো আমাদের মতো সত্যিকারের বাঙালী,মানে যাদের বিরিয়ানীর চেয়ে ডাল-ভাত,আলু-পোস্ত ভাজা,ইলিশমাছের ভাজা,চিংড়িমাছের মালাইকারি ইত্যাদি বেশি ভালোবাসি,তাদের কি কি বিষয়ে গায়ে কাঁটা দিতে পারে ? উমম্,রবীন্দ্র সংগীত বা পথের পাঁচালির সেই epic scene,যেখানে কাশবনের মধ্যে দিয়ে অপু,দূর্গার ট্রেন দেখা ? আরো অনেক কিছুই হতে পারে ।
কিন্তু যদি বলি মহালয়ার ভোরে সাতসকালে উঠে সেই ভদ্রলোক মানে বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের সেই ever green কন্ঠস্বর,আর সেই কন্ঠস্বর যখন বলে ওঠে না—“ যা দেবী সর্বভূতেষু—”,সত্যি গায়ে কাঁটা দিয়ে ওঠে মনে হয়,হ্যাঁ এবার পূজো আসতে চলেছে ।
মি নিশ্চিতভাবে বলতে পারি যে পূজোর আগে ওনার কন্ঠস্বর যদি না শোনা যায় তাহলে—
না,আমি মহালয়া বা শ্রী বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের ব্যাপারে কোনো information দেবো না,আমি শুধু আপনাদের একটা একটা ছবি দেখাবো,যে একটা সকাল,যেটা বাকি অন্য সকালদের থেকে কিভাবে সবার কাছে আলাদা হয় ।
একটা অ্যাপার্টমেন্ট,মানে ফ্ল্যাট টাইপ মানুষজন যারা,তারা কি বোঝে মহালয়াটা রেডিও বা গ্রামোফোন এ শোনার যে একটা সেইইইইই— ব্যাপার আছে ? কিছুজন হয়তো বোঝে,যারা এখন বয়োজ্যেষ্ঠ । কিন্তু সেই ঢাউস আকারের রেডিওটা আর পায়না,যেটা ভোর ৪ টার সময় চালালে শুনতে পাওয়া যায়,“আপনারা শুনছেন আকাশবাণী কলকাতা খ—” । তো এসব নিয়ে যদি তারা এখন তাদের ছেলে-মেয়েদের কাছে অভিযোগ করেন তার প্রত্যুত্তরে অনেকেই বলেন,“উফফফ্,বাবা নেটে থেকে ডাউনলোড করে দিচ্ছি,শুনে নিও আর প্লিজ সকালবেলা আমাকে ঘুম থেকে তুলো না—” ।
মি শুধু বলবো পূজোর সময় প্যান্ডলে ঘোরা,ম্যাডক্সে আড্ডা বা বিরিয়ানি খাওয়া মানে পূজোর আনন্দ নয় । যদি তুমি ভোরের সকালে উঠে ঘুম ঘুম চোখে উঠে,বাবা কোলে মাথা রেখে “আশ্বিনের শারদপ্রাতে—” না শুনলে,বুঝবে না এর আবেগটা কোথায় । এমন অনেকে থাকে যারা মহালয়া ঠিকমতো শোনেইনি হ,তারা ফেবুতে পোস্ট শেয়ার,“ #mahalaya ” ।
খন তো whatsapp story ও এসে গেছে ।আর বাবুঘাটে পূর্বপুরুষদের উদ্দেশ্যে তর্পণ দেওয়ার ঢল তো একটা নষ্ট্যালজিক ব্যাপার । তো সে যাই হোক এসবের মধ্যে দিয়েও শুরু পূজোর তোড়জোড় ।এর মধ্যে দিয়েই শুরু হয় বাঙালির আবেগের একমাস । আর এই একমাস পুরো শহর ভীড় জমায় গড়িয়া হাট বা এসপ্ল্যানেডে,নতুন জামা কাপড় কিনতে হবে যে ।
আজ আবার মহালয়া হাতে সময় কম ১০—১৫ টা । কিন্তু উত্তর কলকাতার ছবিটা বোধহয় একটু আলাদা । সেখানে এখনো রেডিওটা জানলার পাশে নিয়ে বসে,চোখ বুজে শুনতে থাকা পাড়ার দাদু অদ্ভূত তৃপ্তিতে হাসে । কিংবা কোনো বাড়ির দালান বা রোয়াকে বসে পাড়ার ছেলেরা রেডিওতে— । একটু জমিদার বাড়ির মানুষরা তাদের বহু পুরোনো গ্রামোফোনটা তে মহালয়া অনেক কষ্টে চালিয়ে বিশ্বজয়ের অনুভূতি নেয় ।
আচ্ছা তো গ্রামে কি হয় কি,বাড়ি বাড়ি টিভি থাকেনা আবার বাড়ি বাড়ি রেডিও থাকেনা । তো যখন কিছু স্পেশাল কিছু জিনিস হয়,পুরো গ্রাম উঠে আসে একটা বাড়িতে,আর এটাই ওদের কাছে অনেক বড়ো ব্যাপার । গ্রামে তো তখন যথারীতি কাশফুলের বন । অদ্ভূত একটা ঠান্ডা ঠান্ডা ভাব, যেন কেউ একটা কিছু খুশির খবর নিয়ে এসেছে ।
ল পালানে ছেলে গুলো কাশফুল গুলোকে নিয়ে রাস্তায় দৌড়াদৌড়ি শুরু করে দিয়েছে । তো মোটামুটি সবাই বুঝে যায় যে পূজো আসতে চলেছে । ওদিকে প্যান্ডল বাঁধার কাজ শুরু,শহরের মতো অনেক পূজো হয় না । একটা দুটো হয় তাতেই পুরো গ্রাম উঠে আসে । তো এমনই এক ভোর,মানে মহালয়ার ভোরে গোটা গ্রাম জোড়ো হয় । তারপর শুরু হয় সেই বিখ্যাত কন্ঠস্বরের জাদু যেটা শুনে সবার কপালে আপনা থেকেই হাত জোড়ো হয়ে আসে এমনকি ঐ ১০ বছরের বাচ্চাটাও চুপচাপ শুনে যায় ।
রিদিকটা কেমন চুপচাপ থাকে,শান্ত ঠিক যেন কোনো কিছু আসতে চলেছে আর সবাই তার জন্য সেজেগুজে অপেক্ষা করছে । আর এসব অনুভূতি সৃষ্টি করার জন্য দায়ী হলেন এই ভদ্রলোক,শ্রী বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র যিনি নিজেও হয়তো জানেন না যে তিনি বাঙালির আবেগটা কে এখনো কোন পর্যায়ে তুলে রেখেছেন ।
যারা প্রবাসী মানে কাজের সূত্রে বাইরে আর তারা বাঙালীয়ানাটাকে খুব মিস করেন । হয়তো তারা সেই মহালয়ার ভোরে পূজো পূজো গন্ধটা পাবেন না । তবুও বলবো চোখ বন্ধ করে ছোটবেলার কথা যদি আপনি একবার ভাবতে পারেন, তাহলে মনে কষ্ট একটু হয়তো হবে যে ঐ জায়গায় যেতে পারছেন না কিন্তু feelings টা নিতে পারবেন ।
আসলে বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের মহালয়ায় এমন একটা যাদু আছে যেটা,সে গ্রামের কোনো লাজুক নতুন বউ বা শহরের নতুন প্রজন্ম কিংবা চায়ের দোকানে কাজকরতে বাচ্চা ছেলেটার কানের মধ্যে একবার ভেসে আসে,তাহলে একমুহূর্তের জন্য হলেও মনে হবে হ্যাঁ কোনো কিছুর জন্য এখনো বাঙালিরা বেঁচে আছে ।
খনো একটা লাইন ও যদি কোনো বাঙালি শোনে তার গায়ে কাঁটা দিতে বাধ্য ।
এমনই এক সকালে,আশা করবো আপনারা উঠেছেন,তারপর একবার বাইরেটা দেখবেন হালকা শিশির পড়েছে,তারপর ফিরে এসে রেডিওর পাশে গিয়ে বসবেন আর শুরু হবে,
“আশ্বিনের শারদপ্রাতে বেজে উঠেছে আলোকমঞ্জির—”