বিবাহ অর্থাৎ প্রচলিত অর্থে বিয়ে একটি বন্ধন যা মানুষকে সারাজীবনের জন্য একজন প্রকৃত সঙ্গীকে খুঁজে দেয়। কখনোই এটা যেন কোনো মানুষের জীবনে শৃঙ্খল অর্থাৎ শিকল হয়ে না যায়। বিবাহ একটি প্রথা যার মাধ্যমে একজন মানুষ তার জীবনের প্রিয় মানুষটিকে সারাজীবনের জন্য তার সঙ্গী হিসাবে স্বীকৃতি দিতে পারে। মানুষ সমাজবদ্ধ জীব একথা ঠিক। সমাজের বেশ কিছু রীতি নিয়ম আমরা মেনে চলি। বিবাহ নিয়ে কিছু সামাজিক রীতিনীতি প্রচলিত আছে তবে সেই আচার অনুষ্ঠান কখনোই মুখ্য নয়। বিয়ের মূল উদ্দেশ্য দুটি মানুষের মনের মিলন। অনেকসময় সেই মিলনকে কেন্দ্র করে সমাজের সামনে তাদের পরিবার কিছু নিয়ম এবং অনুষ্ঠান পালন করে থাকে।
বিবাহ নিয়ে লেখার কারণ হল সম্প্রতি গুয়াহাটি হাইকোর্টের এক মামলায় দুই বিচারপতি অজয় লাম্বা এবং সৌমিত্র শইকিয়ার বক্তব্য আমাদের বিস্মিত করেছে। বিবাহবিচ্ছেদ সংক্রান্ত একটি মামলার রায় ঘোষণা করতে গিয়ে তারা বলেন, যে হিন্দু বিবাহিত নারী শাঁখা সিঁদুর পরতে অস্বীকার করে সে আসলে নিজেকে অবিবাহিত বলেই মনে করে। এই বক্তব্য যেমন বিস্ফোরক তেমনি লজ্জাদায়কও বটে। হিন্দু ধর্মে বিয়ের পরে শাঁখা-পলা-লোহা-সিঁদুর প্রভৃতি মহিলাদের পরে থাকার চল আছে অনেকক্ষেত্রে, তবে এটা নেহাতই লোকাচার। এটি বাধ্যতামূলক কোনো নিয়ম হতে পারেনা। এমনকি পুরানে এর কোনো উল্লেখ পাওয়া যায়না। আর কোর্ট তো কোনো ধর্মের বিয়েকে প্রাধান্য দেয়না, আদালতের কাছে আইনসম্মত বিয়ে গুরুত্বপূর্ণ। আইনি মতে বিয়ের ক্ষেত্রে ওসব আচার গুরুত্বহীন, কয়েকটি সিগনেচার করেই বিবাহসূত্রে আবদ্ধ হওয়া যায়।
একবিংশ শতকের নারী আজ ঘরে বাইরে সমানতালে কাজ করছে, দক্ষতায় পুরুষদের থেকে কোনো অংশে তারা পিছিয়ে নেই। অনেক লড়াই করে তারা সমমর্যাদা আদায় করেছে। তারপর যদি কেবলমাত্র শাঁখা সিঁদুর বিবাহিত নারীর পরিচয় হয় এর থেকে লজ্জার আর কিছু হতে পারেনা। যে আদালত অগ্নিসাক্ষী করা বিয়ের পরিবর্তে রেজিস্ট্রি ম্যারেজকে স্বীকৃতি দেয় সেখানে বিচারক এমন রায় কিভাবে ঘোষণা করতে পারেন ভেবে আমরা বিস্মিত। বিবাহ একটি অনুভূতির বিষয়, জীবনের একটি গুরুত্বপূর্ণ পর্ব, সামাজিক লোকাচারের অনেক উর্দ্ধে এর অবস্থান। এই ধরণের মন্তব্য বিবাহের প্রকৃত মর্যাদা হরণ করে। আর বিবাহ সম্পর্কে একজন নারী ও পুরুষ যখন আবদ্ধ হয় তখন চিহ্ন বহনের দায়ভার কেবলমাত্র নারীর উপর কেন চাপানো হয়?? একজন পুরুষ তো বিবাহ পরবর্তী সময়ে কোনো বৈবাহিক চিহ্ন বহন করেনা। আজকাল নারীরাও তাই কোনো চিহ্ন বহন করছেনা কারণ বাহ্যিক চিহ্নের উপর বিবাহ নির্ভর করেনা।
বিবাহ নামক প্রতিষ্ঠান এতটাও ঠুনকো নয় যে তা নারীর বহন করা চিহ্নের জন্য টিকে থাকবে। বিয়ে হল ভালোবাসা, সম্মান, বিশ্বাস এবং পারস্পরিক বোঝাপড়া দিয়ে গড়ে ওঠা একটি প্রতিষ্ঠান। বিবাহ নারী ও পুরুষকে পৃথক আসনে বসানোর কোনো লোকাচার নয়, এটি মনের ব্যাপার। যখন দুজনের মনে পরস্পরের প্রতি অনুভূতির ঘাটতি হয় তখন বিবাহবিচ্ছেদের পথে যায়। অসমের এক দম্পতির বিবাহবিচ্ছেদ সংক্রান্ত মামলাকে কেন্দ্র করে এইধরণের বক্তব্য বিয়ের গুরুত্বকে লঘু করে দেয়। গত চল্লিশ বছর ধরে নারীদের স্বার্থে অনেক আইন প্রণয়ন হয়েছে এবং অনেক লড়াই করে তারা সেগুলো অর্জন করেছে। আইনত ভাবে বিয়ের পরে মেয়েরা পদবী পরিবর্তন করতে বাধ্য নয় এবং কোনোরূপ চিহ্ন বহন করতে বাধ্য নয়। তাই এই যুগে কোনো বিচারপতির এই ধরণের মন্তব্য করার অর্থ নারীদের মর্যাদাহানি করা। নারীদের পিছিয়ে নিয়ে যাবার জন্য এই ধরণের কথাবার্তা কিছু মানুষজন বলে থাকে, তবে একজন বিচারকের মুখে এই কথা সত্যি মানায়না। এরফলে সমাজ আগামীদিনে পিছিয়ে পরবে। বিবাহ নামক পবিত্র বন্ধনের সম্পর্কে ধারণা নষ্ট হবে। বিয়ে নারী ও পুরুষের মধ্যে এক পবিত্র বন্ধন নির্মাণ করে যা কোনো বাহ্যিক আচার বিধির উপর নির্ভর করেনা, এটা আধুনিক যুগে মনে রাখা প্রয়োজন।
আসলে এইধরণের কথা বলে মেয়েদের নিচু প্রমান করার যে মানসিকতা তা অত্যন্ত নিন্দনীয়। শিক্ষিত, আইন জানা পুরুষরা যদি এইধরণের কথা আদালতে বলেন এতে সত্যিই জনস্বার্থ ক্ষুন্ন হয়। একজন মানুষের বিচার হয় তার কাজের মাধ্যমে। বিবাহিত নারী যদি শাঁখা সিঁদুর না পরলে তার দিকে বিয়ে ভাঙার জন্য আঙ্গুল তোলা হয় তাহলে বলতে হয় নারীরা আজও বঞ্চিত। এইসব কথা নারীদের পক্ষে যথেষ্ট অপমানজনক। বিয়ে টিকিয়ে রাখতে চিহ্ন বহন করা নিষ্প্রয়োজন। আর বিবাহ টিকিয়ে রাখার দায়িত্ব উভয়ের। হিন্দু ধর্মের ক্ষেত্রে একটা ব্যাপার মাথায় রাখা প্রয়োজন সব হিন্দু রাজ্যে বিয়ের পরে মহিলাদের সিঁদুর লোহা প্রভৃতি পরতে হয়না। যেমন রাজস্থান, গুজরাট সহ উত্তর ভারত ও দক্ষিণ ভারতে শাঁখা সিঁদুর পরার কোনো প্রচলন নেই বিয়ের পরে। অর্থাৎ এসব হিন্দুধর্মের নিদর্শন হতে পারেনা।
এইধরণের নিয়ম নীতি কেবল বাঙালিদের মধ্যেই প্রচলিত আছে তবে এসব কখনোই বাধ্যতামূলক নয়। এগুলি কেবলমাত্র লোকাচার মাত্র। লোকাচারের বেড়াজালে বিবাহকে বাঁধতে গেলে তার প্রকৃত মর্যাদা নষ্ট হয়। এসব নিয়ম মেনে চলার মাধ্যমে নারীকে পুরুষের সম্পত্তি হিসাবে দেখা হয়। বহুকাল ধরে পুরুষতান্ত্রিক সমাজ নারীদের এই চোখেই দেখে এসেছে। এসব বেপরোয়া মন্তব্যের ফলে নারীদের দমন করার আরও চেষ্টা হবে। বিবাহ যদি শিকল হয়ে যায় তা খুব লজ্জাজনক, বিয়ের পরে পুরুষরা যদি নিয়মের ছলে স্ত্রীর পায়ে বেড়ি পরাতে চায় তা অত্যন্ত ক্ষতিকারক। পুরুষদের মনে রাখা প্রয়োজন ‘অর্ধেক আকাশ’ যদি মেঘে ঢেকে যায় তাহলে বাকি অর্ধেক কখনোই আলোকিত হতে পারেনা। ‘অর্ধেক আকাশ’ অর্থাৎ নারীজাতির প্রাপ্য মর্যাদা, ন্যায্য অধিকার নারীরা কখনো ক্ষুন্ন হতে দেবেনা।