বোঝাপড়া

আমার সদ্য ব্রেক-আপ হয়েছে, পাঁচ বছরের একটা সম্পর্ককে চোখের সামনে সেদিন ভেঙে যেতে দেখেছি,সেদিন কোনো বাজ পরেনি..বিদ্যুৎ চমকায়নি..তবুও খুব জোরে আওয়াজ করতে করতে মনটা বোধহয় পুরোপুরি ভেঙে গেলো, বুঝতে পারলাম।

সম্পর্কটা যে আর নেই, তা আমি মেনে নিয়েছি খুব সহজেই,যে ঘরের চালটাই ভাঙা, তা একদিন ভেঙে-চুরে পরতই, একটা-দুটো বর্ষাকাল নাহয় প্লাস্টিক লাগিয়ে চালিয়ে নেওয়া যায়, কিন্তু সারাজীবনটা তো সেভাবে চলে না।

আমি কখনই চেষ্টা করিনি ভুলে যেতে,বরঞ্চ চেষ্টা করেছি কত বেশি করে মনে রাখা যায়,কারণ সিদ্ধান্তটা আমার ছিলো,যাকে ভালোবেসেছি তাকে ভুলতে চাওয়াটা নিজের ভালোবাসাকে অপমান করা,নিজের সিদ্ধান্তকে অস্বীকার করা। আমার যদি ভুলতেই হয়,তবে ভুলে যাবো যে কত কথা দেওয়া-নেওয়া হয়েছিল যা রাখা হলো না।

অনেকদিন মনখারাপ,কান্নার পর আমি দেখলাম যে আমি অনেকটা স্বাভাবিক, এই যে বললাম “স্বাভাবিক”, এই একটা শব্দর মধ্যেও কিন্তু অনেক শব্দ আছে,কথা আছে,অনেক গুলো দিন আছে,খুব সহজ শব্দ এটা নয় মোটেই।

আমার দাদার ছেলে হলো,ওর মুখটা দেখে মনটা নড়ে উঠলো,বুঝলাম যে ভিতরটা এখনো জীবত, সেদিনই মরে যায়নি। ওর নাম রাখা হলো ‘তাতোন’, যতবার ওর নামটা উচ্চারণ করলাম…মনটা আনন্দে ভোরে গেলো,অনুভব করলাম..ঠিক এইরকম সুখ আমি আগে কখনো অনুভব করিনি।ওকে দেখে প্রায় সব ভুলে থাকা যায়, তাতোনকে ভালোবেসে ফেললাম, আর বুঝলাম আমি স্বাভাবিক হতে পারবো।

একদিন ভোরবেলা ঘুম থেকে উঠে দেখি আমার নীলকণ্ঠ ফুল গাছটার তলায় প্রায় 15-16 টা নয়নতারার ছোটো-ছোটো চারা,বুঝলাম কোনো পাখি ভুল করে মুখে করে নিয়ে যেতে-যেতে ফেলে গেছিলো কোনোদিন।আমি পাখিটাকে ভালোবেসে ফেললাম আর সাথে ওই চারা গুলোকেও। বুঝতে পারলাম আসতে আসতে আমি ঠিক হচ্ছি।

কলেজ থেকে ফেরার পথে রোজ একটা মন্দির পরে,সেই মন্দিরের সামনে কত লোক দিন-রাত বসে থাকে, সেদিন দেখলাম একটি ছেলে আর একটি মেয়ে যত সম্ভব প্রেমিক-প্রেমিকাই হবে,হাতে অনেকগুলো খাওয়ারের প্যাকেট,শুনলাম মেয়েটা ছেলেটাকে বললো – ছাগল,তুই দিস বা আমি দি একিই তো ব্যাপার। আমি ওদের প্রেমটার প্রেমে পরে গেলাম তৎক্ষণাৎ। বুঝতে পারলাম আমার মধ্যে অস্বাভাবিক জিনিসটা আর অতটা প্রবল নেই।

আমার একটা বান্ধবী কানের দুল পরতে খুব ভালোবাসে,একদিন ও বেশ সুন্দর একটা কানের দুল পরে কলেজে এলো,জিজ্ঞেস করাতে বললো – আরে বাবাটা এতো পাগল যেখানেই দোকান দেখবে কানের দুলের,কিছু না কিছু কিনে আনবে। আমি ওর বাবার ভালোবাসার প্রেমে পরলাম কিছুটা।

একদিন খুব ভোরে ঘুমটা ভেঙে গেলো,একরকম এক পাখি ডাকে শুধু ভোরবেলায়,কেমন জানো ঘোর লেগে যায় সেই ডাকে…পাখিটাকে না দেখে,শুধু ওর আওয়াজটার প্রেমে পরে গেলাম।

জয় গোস্বামীর ‘ভেঙে যাওয়ার পরে’ বইটা পড়ে.. আমি ওনার লেখা প্রতিটা লাইনের প্রেমে পড়লাম।

আমার ভালো রেজাল্ট দেখে বাবা যে হাসিটা হাসে,আমি খেয়াল করে দেখলাম, ওরকম ভালোবাসা আমি কাউকে বাসিনি কখনো।

কোনো এক নাম না জানা ফুলের একটা অদ্ভুত গন্ধ আছে, আলুকাবলির মতন,কোথাও গন্ধটা পেলে আমার মনে হয় সামনেই কোনো আলুকাবলির দোকান আছে। ফুলটাকে আমি সারাজীবন ধরেই ভালোবাসি।

একদিন আমার এক বন্ধু আমায় একটা গান পাঠিয়ে বললো- এই গানটা শুনলে তোর কথা মনে পরে,আমার তখন যে ভালোলাগার অনুভূতিটা হলো,আমি ওই অনুভূতিটাকে ভালোবেসে ফেললাম।

অনেক ভেবেচিন্তে দেখলাম আমি অনেক কিছুকেই ভালোবাসি, শুধু একটা মানুষ,তার জীবন,তার সাথে কাটানো অনেক মুহূর্ত ছাড়াও আমার মধ্যে অনেকজন, অনেক কিছুর জন্য ভালোবাসা জমে আছে। আমি ভালোবাসা দিতে চাইলে তারা সারাজীবন নিয়ে যাবে সেই ভালোবাসা।

উপলব্ধি হলো যে আমরাই ভুলটা করি,কারন আমরা এক সমুদ্র জলকে একটা পাত্রের মধ্যে ভরে রাখতে চাই,একটা বিশাল বটগাছকে কেটে-কুটে টবে বসাতে চাই..এক আকাশ মেঘকে নিয়ে আসতে চাই একটা ছোট্ট ঘরে, হয় কখনো এরকম? ভালোবাসাটাও ঠিক তাই।

আমাদের মধ্যে এক আকাশ,এক সমুদ্র, আর এক বিশাল বটগাছের সমান প্রেম থাকে, তার সবটা আমরা হয়তো চোখে দেখতে পাইনা, চারিদিকে প্রেম ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকে,আমরা কখনো সবটা গুছিয়ে নিয়ে এক জায়গায় করে দেখিনা।

দেখলে বুঝতাম হয়তো, হতেই পারে একজন সে প্রেম নেয়নি,কিন্তু বাকি সবাই প্রতিটা দিন,প্রতিটা মুহূর্তে আমাদের প্রেমটা শুধু নিচ্ছে তা নয়,সেটা ফিরিয়েও দিচ্ছে দ্বিগুন ভাবে।এটাই নিয়ম,এটাই হয়ে আসছে…কেউ খুব ভালোবাসা দিচ্ছে আর কেউ দেখছেও না ভালোবাসাটার সিকিভাগও।

কিন্তু আমি এখন বিস্বাস করি যে ভালোবাসাটা খুব সহজলভ্য,সহজলভ্যতার মধ্যেই ভালোবাসাটা পাওয়া যায় আর যা সহজলভ্য তা সারাজীবনের।

“টেকেন ফর গ্র্যান্টেড” এসব কথাগুলো প্রেমে চলে হয়তো,কিন্তু সংসারে অভ্যেসটাই আসল। সহজে পেয়ে যাওয়াটাই ভালোবাসা। তাই কঠিন কোনো কিছুর দিকে আর না যাওয়াটাই ভালো, এবার একটু বোঝাপড়া করে নিন নিজের সাথে, এতদিন যেমন দিয়েছেন এবার নিজের গ্রহণ করার পাত্রটা বাড়িয়ে দিন, দেখবেন পাত্র ভরে যাচ্ছে।

মনে রাখবেন, একটা গাছে একটা ফুল একা ফুটে থাকলেও কিন্তু সেটা কখনো কম সুন্দর বা অসুন্দর হয়ে যায়না।মনে রাখবেন, একটা গাছে একটা ফুল একা ফুটে থাকলেও কিন্তু সেটা কখনো কম সুন্দর বা অসুন্দর হয়ে যায়না।

ভালোবাসা সবাই পায়, শুধু সেটা দেখতে পায়না বা চায়না। এক রং-এর বিভিন্ন শেড হয় যেমন, তেমনি ভালোবাসা শব্দটারও অনেক রকম আছে,একটা রং নয় আপনার কাছে নেই,আকাশ সবসময় আকাশি রং-এরই হতে হবে? লাল,হলুদ,কমলা আকাশও তো হয়। নিজের ইচ্ছামত রং দিয়ে ছবি আকুন,ছবিটা আপনার,ঠিক যেমন জীবনটা।

Facebook Comments Box

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *