পূর্ব বর্ধমান জেলার বড়শুল একটি বর্ধিষ্ণু অঞ্চল, বড়শুলের দে পরিবারে মা দুর্গা আসেন প্রেমময়ী রূপে। দেবাদিদেব মহাদেবের বাম উরুতে অধিষ্ঠান করেন দেবী। দেবীর মুখে থাকে প্রশান্তি এবং তাঁর দৃপ্ত চোখে দেখতে পাওয়া যায় প্রেমময় স্নেহ। দেবী এখানে মহিষাসুরমর্দিনী নন, দশভূজাও নন। বাঘছাল পরিহিত শিবের কোলে বসে দ্বিভূজা দেবী পূজিত হন। শিবের ঢুলু ঢুলু আঁখিদুটিতে থাকে ঘুমভাব। তাঁর ডানহস্তে থাকে ডমরু এবং বামহস্তে শিঙা। তাঁদের ডানদিকে থাকেন দেবী লক্ষী এবং সিদ্ধিদাতা গণেশ। বামদিকে থাকেন দেবী সরস্বতী এবং কার্তিক ঠাকুর। লক্ষী এবং সরস্বতী আসেন বাহন ছাড়াই তবে গণেশ এবং কার্তিকের সঙ্গে তাঁদের বাহন অর্থাৎ ইঁদুর ও ময়ূর থাকে। মহাদেবের আসনের নিচেই বসে থাকে তাঁর বাহন ষাঁড়টি। তবে মা দুর্গার বাহন সিংহ এখানে অনুপস্থিত। নেই কোনো মহিষও।
একচালার প্রতিমা দেখলে মনে হয় একান্নবর্তী পরিবার যেন। হরগৌরী এসেছেন মর্তে তাঁদের সন্তান সন্তোতি নিয়ে। বরাবর একই মূর্তি তৈরি করে পুজো করা হয় এখানে। রথের দিন কাঠামো পুজো হয়, প্রথম মাটি দেওয়া হয়। তারপরে শুরু হয় মূর্তি গড়ার কাজ। মহাষষ্ঠীর বোধন দিয়ে পুজো শুরু হয়। ঐতিহ্য মেনে দে পরিবারের সদস্যরা পুজোর রীতিনীতি পালন করেন। এই পুজো ২৫০ বছরের বেশি পুরোনো। একসময় দে বাড়ির জমিদারির বৈভব ছিল। তখন পুজোতেও বনেদিয়ানা ছিল দেখার মতো। এখনো জমিদারবাড়ি, ঠাকুরবাড়ি, দুর্গাদালান, নাটমঞ্চ পুরোনো দিনের স্থাপত্যকীর্তির সাক্ষ্য বহন করে। এই পরিবার ছিল বৈষ্ণবধর্মে দীক্ষিত। গুরুদেবের পরামর্শে গোস্বামীমতে দেবীর পুজো করা হয়। সপ্তমীতে গোটা ছাঁচিকুমড়ো বলি হয়, অষ্টমীতে ছাগবলি এবং নবমীতে তিনটে ছাঁচিকুমড়ো, চারটি শশা, বাতাবিলেবু ও মূলসহ তিনটে আখবলির রীতি প্রচলিত আছে। এই পরিবারের কুলদেবতা রাজরাজেশ্বর। তাঁর নিত্যপূজা হয়। তাঁকে প্রতিদিন পুজোর সময় তাঁর মন্দির থেকে এনে মা দুর্গার সামনে রাখা হয়। আবার বলিদানের সময়টুকু তাঁর মুখ পিছনে ঘুরিয়ে দেওয়া হয়। সন্ধিপুজোর পরে বাড়ির মহিলাদের ধূনো পোড়ানোর রীতি আছে। নবমীতে হোমযজ্ঞ হয়, স্ত্রী আচারের প্রচলন আছে। পুজোর প্রতিদিন লুচি বোঁদে থাকে ভোগ হিসাবে। সেই ভোগপ্রসাদ পৌঁছে দেওয়া হয় বিশাল দে পরিবারের প্রত্যেক সদস্যের বাড়িতে। দশমীর দিন পুজোর শেষে বাড়ির সদস্যরা তিনটে বিল্বপত্রে শ্রী শ্রী দুর্গামাতার সহায় লিখে মায়ের কোলে রাখেন। সন্ধ্যায় বরণের সময় মিষ্টি ও পানছেঁচা দেওয়া হয় দেবদেবীদের মুখে এবং বাড়ির সকলে সেই পানছেঁচা মুখে দেন। শেষে বাড়ির মহিলারা সিঁদুরখেলায় অংশ নেন। প্রথা মেনে দশমীর সন্ধ্যায় কাহাররা (ঠাকুরের বাহক) কাঁধে করে হরগৌরীর মূর্তিকে নিয়ে গ্রাম প্রদক্ষিণের শেষে দে বাড়ির পারিবারিক একটি পুকুরে ঠাকুর বিসর্জন করে। প্রচুর মানুষের সমাগম ঘটে এইসময়েও। কাহারদের পরিবারের মানুষজনেরাও আসে, তাদের লুচি মিষ্টি প্রসাদ দেওয়া হয়। সবই হয়ে চলেছে বংশ পরম্পরায়।
এই পুজো শুরুর ইতিহাস আছে। কথিত আছে, পরিবারের কর্তা দেবীর পুজোর স্বপ্নাদেশ পেয়েছিলেন। সেইসময়ে দামোদরে নৌবাণিজ্যর কারণে বণিকরা আসতো জমিদারবাড়িতে। একবার তীর্থযাত্রীদের একটি দল আসে। তাদের মধ্যে এক সাধুর ঝুলিতে ছিল কয়েকটি দেবীমূর্তি। বাড়ির এক কিশোরী মেয়ের চোখ বেঁধে তাকে একটি মূর্তি তুলে নিতে বলা হয়। তার হাতে উঠে আসে এই হরগৌরী মূর্তি। তারপর থেকেই দেবীর পুজো শুরু হয়।
দুর্গাপুজোর পরে কোজাগরী তিথিতে নিয়ম মেনে লক্ষীদেবীর আরাধনা করা হয়। সেই মূর্তিও একটু ভিন্ন হয়। মা লক্ষীর সাথে থাকে দুই সখী জয়া ও বিজয়া। উপরে দুপাশে থাকে দুটি বাঘা। একইভাবে পুজোর সময়ে এবং বিজয়ার সময়ে পরিবারের সকলে আনন্দে সামিল হন।