আরেকটা পঁচিশে বৈশাখ চলে এলো । বাঙালি আবার মাতবে , আবার পাড়ায় পাড়ায় মঞ্চ বেঁধে অনুষ্ঠান হবে , আবার টাইমলাইন ভরে যাবে ভুল বানানে ভরা রবীন্দ্র সঙ্গীতে , আবার মাইকে বাজবে ‘ আগুনের পরশমণি ’ , আবার ওয়ানে পড়া মেয়েটাকে জোর করে ‘ প্রশ্ন ’ মুখস্ত করানো হবে , আবার ধুলো ঝেড়ে মালা পরানো হবে দশবছর আগে গড়িয়াহাট থেকে সস্তায় কেনা ফটোটায় । তারপর আবার কাল থেকে হানি সিংহর গানে উদ্দাম নাচ , বাঁকুড়া মেমসের পোষ্টে গিয়ে কাঁচা খিস্তি , মেমবউ শাশুড়িকে কেন ইলিশমাছ ভাজা করে দিল না , তাই নিয়ে তর্ক আর পাশের বাড়ির রিমলি কোন ছেলের বাইকের পেছনে আধাফুট গ্যাপ না রেখে বসেছিল তাই নিয়ে ঘণ্টাখানেক কেটে যাবে । এভাবেই গত পঞ্চাশ বছর কাটিয়ে দিয়েছি , আরও পঞ্চাশ বছর কাটিয়ে দেওয়াই যায় । বাঙালি সারাবছর রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে আদিখ্যেতা করে আর সেটা ফুলে ফেঁপে ওঠে এই কাঠফাটা রোদের বৈশাখ মাসে । অথচ বাঙালির কালচার কিন্তু আর রাবিন্দ্রিক কালচার নয় । বাঙালির কালচার হল স্ক্রিনশট কালচার । রাস্তার পঞ্চাশটা লোকের মধ্যে উনপঞ্চাশজন গুনে গুনে দুটো কি তিনটে লেখা পড়েছে রবীন্দ্রনাথের । আর হল রবীন্দ্রসঙ্গীত , যেকোনো গানের প্রথম দুলাইনের পরই হোঁচট খাবে শতকরা নিরানব্বইজন । কেনই বা পড়বে !
লুকালে ব’লেই খুঁজে বাহির করা,
ধরা যদি দিতে তবে যেত না ধরা ॥
পাওয়া ধন আনমনে হারাই যে অযতনে,
হারাধন পেলে সে যে হৃদয়-ভরা ॥
আপনি যে কাছে এল দূরে সে আছে,
কাছে যে টানিয়া আনে সে আসে কাছে।
দূরে বারি যায় চলে, লুকায় মেঘের কোলে,
তাই সে ধরায় ফেরে পিপাসাহারা ॥
এটা বুঝতে গেলে তো মাথা খাঁটাতে হবে , সময় খরচ করতে হবে । ‘’ ধরা যদি দিতে তবে যেত না ধরা ॥
’’ – কে ধরবে ? কেন ধরবে ? ধরা যদি দিয়েই দেয় , তবে লুকাল কেন ? এত প্রশ্নের উত্তর খোঁজার চেয়ে “ It`s 100% love ’’ অনেক ভাল । সোজা ভাষায় নিপাট ভালবাসা । সুতরাং মোদ্দা কথা হল বাঙালি এখন রবীন্দ্রনাথ পড়ে না , বোঝার চেষ্টা করে না। শুধু তাঁকে নিয়ে আদ্যিকালের আদিখ্যেতা করে যায় ।
রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে কেন এত মাতামাতি ? আমি মানছি উনি খুব খুব বড় মাপের একজন সাহিত্যিক । প্রথম এশিয়ান হিসেবে নোবেল পেয়েছেন । এই বিশ্ববরেণ্য লেখককে নিয়ে লাফালাফি করাটা স্বাভাবিক কিন্তু কেন ওনাকে ভগবানের পর্যায়ে নিয়ে যাওয়া । জন্মের পর থেকেই সব বাঙালির মনে কেন এটা ঢুকিয়ে দেওয়া যে , রবীন্দ্রনাথ শ্রেষ্ঠ সাহিত্যিক । উনি যে পর্যায়ে গেছেন , সেখানে পৌছনো যাবে না । তুমি কোনোদিন রবীন্দ্রনাথের সমকক্ষ হতে পারবে না । আমরা কেন রবীন্দ্রনাথকে আর পাঁচটা সাহিত্যিকের নজরে দেখতে পারিনা । আমি আজ পর্যন্ত কোন বাঙালি লেখককে বলতে শুনিনি , “ রবীন্দ্রনাথ আমার কলিগ । হ্যাঁ উনি বিরাট সাকসেস পেয়েছেন । আমিও চেষ্টা করব , দেখিনা কতদূর কি হয় ! ’’ আমরা কূপমণ্ডূক হয়েই রয়ে গেলাম । আর সেই জন্যই রবীন্দ্রনাথের পর একশ বছরে আর কোন বাঙালি সাহিত্যিক নোবেল পাননি । এই খানেই আক্ষেপের কারণ । আর অভিমান হয় কোথায় জানেন , রবীন্দ্রজয়ন্তী এলে এত মাতামাতি অথচ জীবনানন্দ জয়ন্তী বা শরৎজয়ন্তী তো লোকে মনেই রাখেনা । কেন এই একপাক্ষিকতা ? কেন এই স্তাবকতা ? কেন শুধু জয়গান ? কোনোদিন কোন পঁচিশে বৈশাখের অনুষ্ঠানে রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে সমালোচনা হতে দেখেছেন ? ওঁর লেখার খামতিগুলো তুলে ধরতে দেখেছেন ! আমি অন্তত দেখিনি ।
আসুন না কাল থেকে রবীন্দ্রনাথকে ভগবান হিসেবে নয় , একজন অনুসরণযোগ্য সাহিত্যিক হিসেবে দেখি , যেভাবে শরৎ , জীবনানন্দ বা সুনীলকে দেখি । মনে রাখবেন ‘ ঠাকুর ’ একটি পদবি মাত্র , শব্দটাকে এত সিরিয়াসলি নেবেন না । আসুন এই আশায় বুক বাঁধি যে অদূর ভবিষ্যতে আরেকজন বাঙালি নোবেলজয়ী সাহিত্যিক বিশ্বের দরবারে বাংলা সাহিত্যের নতুন আকাশ খুলে দিক । রবীন্দ্রনাথের থেকেও বেশি সাফল্য পাক , আরও উঁচুতে উঠুক । তাতে আখেরে বাংলা সাহিত্যেরই উন্নতি । তাই বলি বাঙালি , উদার হও , নতুনদের গ্রহণ করতে শেখ । কূপমণ্ডূক – না কখনই না ।