সুবর্ণলতা ( তৃতীয় পর্ব )

( ১ )
অনেক রাইত হয়েছে । বাইরে আবার বৃষ্টি শুরু হয়েছে । বাবু ঘুমিয়ে পইড়েছে । চাইরদিক কেমন ফাঁকা ফাঁকা , বড্ড এইকলা লাগছে । দেওয়ালে টাঙানো বাবুর বাবার ছবি টা যেন আমার দিইকে চেয়ে হাসছে । মাঝে মাঝে ঠান্ডা এক মুঠো বাতাস আর বৃষ্টির টুপটাপ আওয়াজ ঘুমাতে দিচ্ছে না , বারবার যেন কাছু পুরানো কথা মনে করাইবার জন্যি চেষ্টা করছে । মুুকুন্দবাবুকে ছত্যি ছত্যি মনের মধ্যে ভালো জাইগা করে লিয়েছেন । অসময়ে উনি না থাইকলে আজ কিছুই হতোনি । কুখনো উনাকে খুব ভালোবাইসতে ইচ্ছে হয় আবার কুখনো মনে হয় না , এইটা ঠিক হচ্ছেনি । না,মনটা একেবারেই গুমোট হয়ে আছে , আসলে বাবু ব্যাপারটাকে ঠিক মানতেছেনি । আর আমি চাইনে আমার জন্যি বাবুর পড়াছুনা খারাপ হোক । আচ্ছা আমি কি সারাজীবন নিজের জন্যি কিছু ভাববুনি ? ইয়ে, ইশশশশশ্ ছি ছি , কি সব ভাবছি
একজন বিধবার এসব কথা ভাবাও পাপ । তবুও একবার লক্ষীদি এর সাথে কথা কইতে হবে । একমাত্র দিদিই পারে আমায় সমাধান দিতে । এখন রাত আড়াইটা , অনেক রাত হইছে , ঘুমাইতে হবে । শুধু বৃষ্টিটা এখনো—

( ২ )

মা কি ঘুমিয়ে পড়েছে ? এখন রাত আড়াইটা বাজে , গোটা পাড়া চুপচাপ শুধু বৃষ্টিটা এখনো শব্দ করতিছে । মা বোধহয় সত্যিই ঘুমিয়ে পড়েছে । আজ কেন জানি না হঠাৎ ঘুম ভেঙে গেল ? এই বৃষ্টিটা না । উমম্ না বৃষ্টি নয় , অন্য কারণ । আচ্ছা কেউ যদি কারোর মা এর সম্বন্ধে খারাপ কথা বলে , কার ভালো লাগে শুনতে ? সত্যি মানুষগুলার খেয়ে দেয়ে কাজ পায়নে , কি করে লোকের খারাপ করা যায় সারাদিন সেই চিন্তা । মা কে যে খুব ভালোবাসি , এগুলা শুনলে তাই মাথায় জ্বলন হয় যে । আর মা এর ও কি দরকার ঐ মুকুন্দবাবুর বাড়ি কি কাজ করার ? মিছিমিছি লোকের দুর্নাম শোনার চেয়ে দুটো কম এলে কিছু ক্ষেতি হবেনি । আর ঐ মুকুন্দবাবুটার ও বা আমার মায়ের সাথে কিসের এত পিরিত ? লোকে এত কথা বলে ওগুলা শুনতে বোধহয় ভালো লাগে । বয়স হতে যায় বিয়ে করলেই তো পারে । আর একবার দেখি এর একটা হেস্ত নেস্ত করে ছাড়বো । বৃষ্টিটা বোধহয় একটু ধরেছে , সকালে আবার টিউশন আছে । তেষ্টা পাইছে বড্ড —

( ৩ )

মাটি কুপিয়ে খুব তেষ্টা পেয়েছিল , একটু জল খেয়ে লক্ষী দির বাড়ির দিকে হাঁটা দিলাম । আজ লক্ষীদি মাঠে আসেনে , বোধহয় জাল বুনতেছে । কিন্তু আমায় দেখা করতেই হবে —
—‘আরে , লতা যে , কি রে ? মাঠ থেকে এলি বুঝি ?’
—‘হ্যাঁ দিদি , তুমি আজ এলেনে কেনি ? ’
—‘আর বলিনে লতা , কদিন ধরে কোমরের বাতের ব্যাথাটা চাগাড় দিয়ে উঠছে । এই বয়সে আর পারিনে রে । তবুও সংসার চালানোর জন্য —’
—‘বাবুসোনার কি খবর ?’
—‘সকালে উঠে টিউশনে গেছে সে । ’
—‘ঠিকমতো খেয়াল রাখিস ওর , লতা । অমন সোনার টুকরো ছেলে হয়নে আর । ’
—‘ হ্যাঁ, হ্যাঁ দিদি খেয়াল রাখছি তো । ’
—‘না লতা । আমি পারলুমনে , আমার ছেলে দুটো তাই বাইরে দিনমুজুরের কাজ করে । কিন্তু তোর ছেলে পারবে । ওকে হাতছাড়া করিসনে । বাপ মরা ছেলে । মনে অনেক দুঃখ । সামলে রাখিস । ’
—‘ হ্যাঁ দিদি আমারও তো একমাত্তর আশা । বাবুর বাবা যখন মারা যায় , কতই বা বয়স ওর তখন । সেই তবে থেকে এখনো পর্যন্ত ওকে আগলে আসছি । নিজে মাঝেমাঝে রীটি খাইনে পাছে ওর সকালবেলা শুধু জল না খেয়ে পড়তে যেতে হয় । ও অনেকবার বলেচে ওকেও মাঠে নিয়ে যেতে , একসাথে মাঠ কুপাইবে । কিন্তু আমি বকান দিয়েছি , ওকে পড়তে বলেছি । তারপর—’
—‘ আমি জানি লতা । তুই কি আর কি করেছিস নিজের সংসারের জন্য । আমি জানি তুই অনেক কিছু করেছিস ওর জন্য । সেটা আর কেউ জানুক না জানুক আমি জানি । কিন্তু তুই তো জানিস , এটা পাড়া গাঁ । এখানে লোকে কুৎসা করতে ভালোবাসে । এখানে লোকে বুঝবেনি , মানুষের মূল্য কি । এখানে লোকে বিধবা মানে বোঝে অলুক্ষুণে । বেশি কিছু বলতে গেলে লোকে একঘরে কইরে দেবে । ’
—‘দিদি তুমি কি বলতে চাইছো কি ? আমি কি করলাম ?’
—‘দ্যাখ লতা , পাড়ার লোকে মুকুন্দবাবু আর তোকে নিয়ে —’
—‘উফফ্ , হ্যাঁ দিদি । আমি ভালোবাসি মুকুন্দবাবুকে । শুলেছো ? না আর একবার শুনবে ? আমি ভালোবাসি । ’
চোখ ফেটে জল বেড়িয়ে এলো আমার । উঠোনেই বসে পড়লাম । আপ কি ই বা করবো ?
—‘লতা , এ কি বললি তুই—’

(ক্রমশ)

Facebook Comments Box

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *